ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ভাঙারির কাজ করতে গিয়ে দুই দরিদ্র পরিবারের ছয় সদস্যকে বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। দিল্লিতে প্রায় দেড় দশক ধরে বসবাসরত এই পরিবারগুলো পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বাসিন্দা বলে দাবি উঠেছে এবং ইতিমধ্যেই সেই দাবির পক্ষে অন্তত দশটি সরকারি নথি সংগ্রহ করেছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ প্রশাসন।
এই ঘটনাটি শুধু একটি মানবিক ট্র্যাজেডি নয়, বরং প্রশাসনিক অবহেলা, পরিচয় যাচাইয়ে উদাসীনতা এবং অভিবাসী দরিদ্রদের বিরুদ্ধে চলে আসা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নির্মমতার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। স্থানীয় মুরারই থানার পুলিশ আধার কার্ড, জন্ম সনদ, পঞ্চায়েত এবং ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকদের প্রশংসাপত্র, এমনকি ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকের জমির দলিল পর্যন্ত তুলে এনেছে, যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে আটক হওয়া ব্যক্তিরা ভারতেরই নাগরিক। এদের মধ্যে একজন নারী চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন এবং তার ছোট সন্তানকে ফেলে রেখে জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠানো হয়, এমন অভিযোগও রয়েছে।
ঘটনার বিবরণ থেকে বোঝা যায়, দিল্লি পুলিশের রোহিণী থানা থেকে এই মানুষদের এফআরআরও-র (Foreigners Regional Registration Office) হাতে তুলে দেওয়া হয়, যেখান থেকে তাদের “বাংলাদেশি” বলে ঘোষণা করে উত্তর-পূর্ব ভারতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বিএসএফ তাদের ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ার মাঝে যে প্রশাসনিক স্তরগুলোতে মানুষগুলোর নাগরিকত্ব যাচাই করার কথা ছিল, সেখানে চরম অবহেলা বা ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা দেখা গেছে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম এগিয়ে এসে পরিবারগুলোর পূর্বপুরুষদের জমির দলিল ও অন্যান্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি যে ভিডিও প্রকাশ করেছেন, তাতে দেখা যায় যে বাংলাদেশে পাঠানো নারীরা চোখের জল ফেলছেন এবং কাতরভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দেশে ফেরার অনুরোধ জানাচ্ছেন।
এই ঘটনাটি একটি গভীরতর সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে: যারা সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির, যারা দরিদ্র, যাদের সামাজিক বা রাজনৈতিক শক্তি নেই, তারা পরিচয়হীন হয়ে ওঠার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এই পরিবারগুলো, যাদের ওপর ভারতের সংবিধানগত অধিকার প্রযোজ্য হওয়ার কথা, তারা এখন এক কাপড়েই বাংলাদেশের কোনও গ্রামে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অভিযোগ অনুযায়ী তাদের জোরপূর্বক ছবি তোলা, হাতের ছাপ নেওয়া, শারীরিক পরীক্ষা করানো এবং জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে।
এখানে দিল্লি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা কাগজপত্র যাচাই না করে কেবল “বাংলাদেশি” সন্দেহে লোকজন ধরে ফেলছে। এর আগে একই ধরনের আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেখানে হরিয়ানায় বাংলাভাষী মুসলমানদের আটক করে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। আবার সম্প্রতি জানা গেছে যে, ভারত সরকার ২০০০-এর বেশি “বাংলাদেশি”কে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তবে এই ধরনের অভিযানগুলো আদৌ কতটা সত্যিকারের অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে আর কতটা গরিব, অশিক্ষিত, সংবেদনহীনভাবে বাছাই করা মানুষের বিরুদ্ধে, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।
একদিকে ভারতে অভিবাসন সমস্যা একটি বাস্তব চ্যালেঞ্জ, তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এর সমাধান কখনোই এভাবে নির্বিচারে মানুষকে তাদের মাতৃভূমি থেকে ছিন্ন করে নয়। নাগরিকত্ব প্রমাণের যথাযথ প্রক্রিয়া রয়েছে, এবং তা অনুসরণ না করেই কাউকে বহিষ্কার করা সাংবিধানিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রশংসনীয় হলেও, এটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রশ্ন তোলে।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশের কোনো গ্রামে এখন হয়তো ভারতের একান্ত নাগরিক কয়েকজন শিশু ও নারী মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন, যাদের জীবনকে এক নিমিষে উল্টে দিয়েছে স্রেফ প্রশাসনিক একটি সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক বন্ধুত্বের প্রশ্নেও এই ধরনের ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে পারে। যদি বাংলাদেশের ভেতরে এই মানুষগুলোর উপস্থিতি ও অবস্থান নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়, তবে তা দুই দেশের মধ্যকার আস্থার সংকটও ডেকে আনতে পারে।
অবিলম্বে এই ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত, পরিবারগুলোর নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে তাদের ফেরত আনা, দোষীদের শাস্তি এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা না ঘটে তার জন্য উপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। না হলে রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতা ও অবহেলার বলি হয়ে প্রতিদিনই কেউ না কেউ নিজের জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত হবেন, আর আমরা তাকিয়ে থাকবো কেবল প্রতিবাদের পোস্টে, ভিডিওতে আর আদালতের দীর্ঘ অপেক্ষায়।
আপনার মতামত জানানঃ