৫৪৫ মিলিয়ন বছর আগের কিছু পায়ের ছাপ বিজ্ঞানীদের ভাবনার জগতে এক নতুন আলোড়ন তুলেছে। এতদিন যে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণকে প্রাণের বিবর্তনের নাটকীয় সূচনা বলা হতো, নতুন গবেষণা বলছে সেই সূচনা আদৌ ততটা হঠাৎ ছিল না। বরং, বহুকোষী জটিল জীবের বিকাশ শুরু হয়েছিল আরও আগে—কমপক্ষে ১৫ মিলিয়ন বছর আগে।
বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষকরা প্রায় ৫৪৫ মিলিয়ন বছর পুরনো ট্রেস ফসিল বা জীবের চলাচলের চিহ্ন বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, সেই সময় পৃথিবীতে এমন কিছু প্রাণী ছিল যাদের দেহ খণ্ডিত, পেশিবহুল এবং সেন্সরি ক্ষমতা ছিল। তারা দিকনির্দেশনামূলকভাবে চলাচল করতে পারত এবং পরিবেশ অনুযায়ী নিজেদের মানিয়ে নিতে পারত। এ সব চিহ্ন স্পষ্টভাবে বলে দেয়, ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ আসলে কোনো হঠাৎ ঘটনার ফল নয়—বরং ছিল একটি দীর্ঘ বিবর্তন প্রক্রিয়ার পরিণতি।
সাধারণভাবে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ বলতে বোঝায় ৫৩০ মিলিয়ন বছর আগে হঠাৎ করেই জীবজগতে বিস্ময়কর বৈচিত্র্য ও জটিলতা দেখা যাওয়া। তখন পৃথিবীর অনেক প্রাণী প্রথমবারের মতো শক্ত দেহাবরণ (exoskeleton), চোখ, জটিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ইত্যাদি নিয়ে আবির্ভূত হয়। এটি এতদিন পর্যন্ত জীববিজ্ঞানে এক বিরল ও আকস্মিক বিবর্তনমূলক ঘটনা হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু নতুন প্রমাণ বলছে, তার আগে থেকেই পৃথিবীতে ছিল চলাচল করতে সক্ষম, গঠনগতভাবে জটিল প্রাণীরা।
গবেষণায় ব্যবহৃত ট্রেস ফসিল, অর্থাৎ জীবের দ্বারা তৈরি পায়ের ছাপ বা গতি-চিহ্ন, আসলে শরীরের জীবাশ্ম নয়। এগুলো থেকে বোঝা যায় সেই প্রাণী কীভাবে চলাফেরা করত, কী ধরনের পরিবেশে বাস করত এবং তার আচরণ কেমন ছিল। গবেষক ওলমো মিগেজ সালাস বলেন, “ট্রেস ফসিল আমাদের জীবের আচরণ ও পরিবেশ সম্পর্কে অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি দেয়, বিশেষ করে যখন সেই প্রাণীর দেহের কোনো শক্ত অংশ ছিল না যা জীবাশ্মে রূপ নিতে পারে।”
এই গবেষণার মূল ফোকাস ছিল এডিয়াকারান ও ক্যামব্রিয়ান যুগের সন্ধিক্ষণ। এ সময়কার পরিবেশ ছিল একটি রূপান্তরকাল, যেখানে এডিয়াকারার নরমদেহ প্রাণীরা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে ক্যামব্রিয়ান যুগে শক্ত কাঠামোযুক্ত জটিল প্রাণীদের জায়গা করে দেয়। গবেষণাটি বলছে, ৫৪৫ মিলিয়ন বছর আগের যে পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে, তা করেছে এমন প্রাণী যাদের শরীর লম্বাটে ও নমনীয় ছিল এবং যারা পেশির মাধ্যমে চলতে পারত।
এই চলাফেরা ছিল নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, এবং প্রাণীটি সম্ভবত মাটির নিচে থাকা নানা খাদ্য খুঁজে খেত। গবেষকেরা বলছেন, তারা হাইড্রোস্ট্যাটিক বডি, সেগমেন্টেশন এবং সেন্সরি ক্ষমতা নিয়ে আশেপাশের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে চলত। এমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবন যে এত আগে থেকেই বিকশিত হচ্ছিল, তা বোঝা গেলে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ নতুন চোখে দেখতে হয়।
এই গবেষণায় যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। গবেষকেরা ট্রেস লাইনের আকার ও আনুপাতিকতা বিশ্লেষণ করে প্রাণীর শরীরের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, দিকনির্দেশনা এবং গতি সম্পর্কে ধারণা নিয়েছেন। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে চারটি প্রধান ট্রেস ফসিল—Archaeonassa, Gordia, Helminthopsis, এবং Parapsammichnites—এর উপর।
এই গবেষণার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পরিমাণগত (quantitative) পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এসব ট্রেস ফসিল। আগেও কিছু গবেষণায় বলা হয়েছিল যে, এডিয়াকারান যুগেও কিছু প্রাণী চলাচল করতে পারত। তবে সেগুলোর বিশ্লেষণ ছিল গুণগত এবং তুলনামূলকভাবে ধারণাভিত্তিক। নতুন গবেষণা প্রমাণসহ দেখিয়েছে, এসব প্রাণী শুধু চলত না, বরং পরিবেশ অনুযায়ী অভিযোজিতও হতো।
এই আবিষ্কার শুধু ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণের সময়রেখাকেই চ্যালেঞ্জ করছে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন গবেষণাপদ্ধতির পথ খুলে দিচ্ছে। গবেষকেরা আশা করছেন, এ ধরনের ট্রেস ফসিল বিশ্লেষণের মাধ্যমে আরও বহু যুগের বিবর্তন, বিশেষ করে অর্ডোভিসিয়ান যুগের বৈচিত্র্য বোঝা যাবে।
গবেষণার প্রধান গবেষক ওলমো মিগেজ সালাস বলেন, “এই নতুন গাণিতিক মডেল ভবিষ্যতের গবেষণায় ট্রেস ফসিল বিশ্লেষণের জন্য এক শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। এর মাধ্যমে প্রাণীর দেহ গঠন, চলার ধরন এবং আচরণ সম্পর্কেও বিস্তারিত বোঝা সম্ভব হবে।”
এই গবেষণার মাধ্যমে স্পষ্ট হলো যে, পৃথিবীতে জটিল প্রাণের আগমন কোনো আকস্মিক বিস্ফোরণ নয়, বরং একটি দীর্ঘ বিবর্তনের প্রক্রিয়া—যার সূচনা ঘটেছিল ক্যামব্রিয়ান যুগের অনেক আগেই।
আপনার মতামত জানানঃ