টেলিগ্রামের পর্দার আড়ালে একটি ক্ষমতাহীন রাজনীতির ট্র্যাজিক কমেডি চলছে। শেখ হাসিনার ভারতে আত্মগমনের এক বছর পর, তাঁর নেতৃত্বহীন দলে এখন টেলিগ্রামই মূল কণ্ঠস্বর। একসময় যাঁরা রাস্তায় থেকে রাজনীতি করতেন, তাঁরা এখন ভার্চুয়াল গ্রুপে রাতের বেলা দমবন্ধ আলোচনায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেই আলোচনাও নিরাপদ নয়—এখন সেখানে অনুপ্রবেশ করেছে গোয়েন্দা, ভেতর থেকে ধরা পড়ছেন কর্মীরা।
টেলিগ্রাম, ভিপিএন, অডিও ক্লিপ, ভার্চুয়াল মিটিং—এগুলো আজকের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বাস্তবতা। যেখানে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার ঢাক বাজিয়ে যারা বছর পার করেছে, তারাই এখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ভিপিএনে ভরসা করছেন। দুঃখজনকভাবে এই বাস্তবতা শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, বরং রাজনৈতিক এক নিঃসঙ্গতা, যেখানে নিজেদের মধ্যেই সন্দেহ, বিভাজন, আর অর্থ নিয়ে টানাটানি চলছে।
যতই বলা হোক শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হচ্ছেন, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠছে তা শুধু ‘ভবিষ্যতের বিভাজনের’ ইঙ্গিত নয়, বরং বর্তমানের আত্মধ্বংসের চিত্র। একসময় যিনি দলের মুখপাত্র ছিলেন, সেই কাদের এখন টেলিগ্রাম গ্রুপে নিজের গুরুত্ব জাহির করতে গিয়ে ব্যর্থ রাজনৈতিক বক্তৃতা আর আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগে বিদ্ধ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা আজ একে একে স্বীকার করছেন, দলটা আর সেই দল নেই। কেউ কেউ বলছেন, ওবায়দুল কাদের নিজেই গ্রুপ তৈরি করে টাকা নিচ্ছেন, কেউ বলছেন হাসিনার ভার্চুয়াল মিটিংয়ের ‘পাস’ পেতে হলে টাকা দিতে হয়। এবং এও জানা যাচ্ছে, এই ধরণের আর্থিক লেনদেনের নেপথ্যে আছেন আরও একাধিক নেতা, যাদের আসল উদ্দেশ্য দল নয়, ব্যক্তিগত টিকে থাকা।
এই সুযোগে অনুপ্রবেশ করেছে এমন এক গোষ্ঠী, যাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ আগে কখনও সরাসরি লড়েনি—ড. ইউনূসপন্থী গোয়েন্দারা। তারা এখন এসব গ্রুপে ঢুকে কথোপকথন রেকর্ড করছে, নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের জন্য ‘ডিজিটাল ফাঁদ’ পাতছে। কেউ কেউ বলছেন, জামায়াত-বিএনপির অনুপ্রবেশ বরাবরই ছিল, কিন্তু ইউনূসের সমর্থকরা যখন গোয়েন্দা পরিচয়ে ঢুকছে, তখন সেটা শুধু দলের নিরাপত্তা নয়, বরং ভবিষ্যতের অস্তিত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সামনে ২০২৬ সালের নির্বাচন। অথচ আওয়ামী লীগ এখনো নিষিদ্ধ। তাই দলটি চায় দ্বিতীয় ধাপে পা রাখতে—টেলিগ্রাম থেকে রাস্তায় নামতে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই দল কাদের নিয়ে রাস্তায় নামবে? যারা টেলিগ্রামে নিজেদের কথাবার্তা রেকর্ড হওয়া থেকে রক্ষা করতে ভিপিএন শিখছে, যারা নিজের দলের নেতার কাছেই বিশ্বাস রাখতে পারছে না, তারা আবার কীভাবে জনগণের মুখোমুখি হবে?
শেখ হাসিনা যে আমূল নেতৃত্ব পরিবর্তনের কথা ভাবছেন, সেটাও শুধু প্রতীকী নয়, বরং বাস্তব। কারণ দল আজ Keyboard Warrior-দের উপর নির্ভরশীল। কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে নেই, বরং রাতের বেলায় ভার্চুয়াল আলোচনার জোয়ারে ভেসে চলছে। আন্দোলন বা সংগঠনের বাস্তব কাঠামো ভেঙে পড়েছে। যারা একসময় ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগকে দিয়ে রাস্তায় আগুন জ্বালাতেন, আজ তারা মাইক্রোফোনে ক্ষীণ স্বর তুলছেন—“প্রতিরোধ গড়ো।”
তারা বলছে, জেলা ও মহানগরে নতুন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হবে। কিন্তু যারা রাত ৯টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত ভার্চুয়াল সভা করে ক্লান্ত, তারা আবার কীভাবে মাঠে নামবে? দলীয় নেতারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ছদ্মনামে গ্রুপে থাকেন, আর কর্মীদের ধরতে পুলিশ লাইন ধরেছে। এই পরিস্থিতিতে গঠন করা প্রতিরোধ কমিটি কি আদৌ প্রতিরোধ করতে পারবে, না হবে শুধুই এক আরেকটি ‘ডিজিটাল প্যারেড’?
এদিকে সবচেয়ে বড় ভয়, দলটি নিজের মধ্যে অসন্তোষ, ভাঙন আর বিশ্বাসঘাতকতায় ভরে উঠেছে। এক নেতা বলছেন, হাসিনার নাম নিয়ে টাকা নেওয়া হচ্ছে, আরেকজন বলছেন, কাদের নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে নতুন নতুন গ্রুপ খুলছেন। এই ভাঙনের মাঝেই প্রশ্ন উঠে—আওয়ামী লীগ আদৌ কী আবার ফিরতে পারবে?
ভারতের আশ্রয়ে থাকা হাসিনার রাজনৈতিক ছায়া আর নিজের দেশে দলে দখল নেওয়া টেলিগ্রাম-কেন্দ্রিক রাজনীতি আজ স্পষ্ট করে দিচ্ছে, আওয়ামী লীগ এক নতুন রাজনৈতিক সংকটে ঢুকে পড়েছে—যেখানে মাঠ নয়, ক্লাউড-ভিত্তিক যুদ্ধ চলছে। যেখানে মিছিল নয়, মেসেজ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনীতি কি কখনও শুধু অনলাইন টেক্সটে বাঁচে?
আর সবচেয়ে বড় কথা—যে দল একসময় মাঠ কাঁপাত, সে দল আজ নিজেরাই নিজেদের ভয় পাচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ