ইতিহাস আমাদের শেখায়, অস্ত্র নয়, অস্ত্রের কৌশলই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে হাতে ধরা পাথর বা তির–ধনুক যেমন যুদ্ধের প্রাথমিক রূপ দিয়েছিল, ঠিক তেমনি আজকের দিনে শব্দের চেয়েও গতি সম্পন্ন হাইপারসনিক মিসাইল, রাডার-অদৃশ্য বিমান ও ড্রোন প্রযুক্তি বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্য পাল্টে দিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই আধুনিক যুদ্ধ বাস্তবতায় বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত? আমাদের কি নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতা গড়ে তোলার চেষ্টা আছে, নাকি আমরা এখনো ‘কেউ আক্রমণ করবে না’ এমন আশ্বাসেই নিশ্চিন্ত?
ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যায়, যুদ্ধ সবসময় প্রত্যক্ষ অস্ত্র দিয়ে শুরু হলেও, শেষ পর্যন্ত বিজয় নির্ধারিত হয় কৌশলগত ক্ষমতা ও প্রযুক্তির আধিপত্যের ওপর। প্রাচীন ভারতে ঘোড়সওয়ারের জন্য বাঁকা তলোয়ার ও পদাতিকের জন্য সোজা তলোয়ারের ব্যবহার ছিল নিখুঁত কৌশলের প্রতিফলন। মধ্যযুগে দুর্গ ও প্রাচীর ঘেরা শহরগুলো সুরক্ষার প্রতীক ছিল, যেগুলো ভাঙতে হলে লাগে বড় কামান বা ক্যাটাপুল্ট। কিন্তু বারুদের আবিষ্কার সে ব্যূহকেও অকার্যকর করে দেয়। একইভাবে আধুনিক যুগে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি যেমন ‘আয়রন ডোম’ বা ‘ডেভিড স্লিং’ও আজ প্রশ্নের মুখে পড়েছে—যখন ইরানি মিসাইল ও ড্রোন সেগুলো অতিক্রম করে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আঘাত হানতে পারে।
সম্প্রতি ইরান–ইসরায়েল সংঘর্ষ আমাদের সামনে বাস্তব উদাহরণ হিসেবে হাজির হয়েছে। ইরান, যাকে দীর্ঘদিন ধরে নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে প্রযুক্তি ও বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল, আজ তার স্বদেশে তৈরি ড্রোন, ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সামরিক শক্তিধর ইসরায়েলকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। ইসরায়েল এতদিন দাবি করে আসছিল, তাদের আয়রন ডোমই বিশ্বের সেরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা—ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, জনগণ আতঙ্কিত হয়ে দেশ ছাড়ছে। বিশ্বাসের দেয়াল ধসে পড়েছে।
এই বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্য একটি জাগরণী ঘণ্টা হওয়া উচিত। আমরা প্রায়ই শুনি, ভারত যদি আক্রমণ করে, আমরা কয় ঘণ্টা টিকতে পারব? এর উত্তর হাহাকার করে না, বরং চূড়ান্ত আত্মসম্মানবোধ ও কৌশলগত পরিকল্পনার মধ্যে থাকা উচিত। সত্যি বলতে কি, ভারতের সঙ্গে সামরিক শক্তির তুলনা অর্থহীন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরা কি এতটাই অসহায় যে, আত্মরক্ষার একটি সম্মানজনক ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে পারি না?
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মানেই অস্ত্রের মজুদ নয়, বরং কৌশলগত চিন্তা, প্রযুক্তি ব্যবহার ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। যেমনটি করেছে ইরান। তারা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থেকেও ড্রোন ও মিসাইল প্রযুক্তি বিকাশ করেছে, নিজস্ব উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে, সাইবার প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল আত্মরক্ষা—একটি যুদ্ধের ভয় নয়, বরং শত্রুকে নিরুৎসাহিত করার জন্য যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে সক্ষম হওয়ার মতো সামর্থ্য রাখা। এটিই ডেটেরেন্স বা প্রতিরোধ ক্ষমতা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধারণাটিই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। আমাদের পক্ষে হয়তো ফিফথ জেনারেশন যুদ্ধবিমান বা নিউক্লিয়ার সাবমেরিন কেনা সম্ভব নয়, কিন্তু আমাদের আছে বিশাল জনশক্তি, তরুণ মেধাবী সমাজ ও একটি ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তি খাত। আমরা কি চাইলে নিজস্ব ড্রোন প্রযুক্তি গড়ে তুলতে পারি না? আমাদের কি এমন কিছু বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেই, যারা স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন সিস্টেম বা সাইবার প্রতিরক্ষা সফটওয়্যার বানাতে পারে না? প্রশ্ন হলো—চাই কি না।
আমাদের ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি’ বাস্তবভিত্তিক না হয়ে এখনো অনেকটাই কাগুজে। কোনো যুদ্ধবিমানের ছায়াও যদি একদিন ঢাকায় দেখা যায়, তাহলে কী করব আমরা? যদি রাডার জ্যামিং প্রযুক্তি দিয়ে বিমান ঢুকে পড়ে, তখন কাকে ডাকব? এই প্রশ্নগুলো নিয়েই এখন ভাবার সময়।
একটা জিনিস পরিষ্কার—আমরা যতদিন আমাদের প্রতিরক্ষা কৌশল নিয়ে আন্তরিক না হব, ততদিন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মঞ্চেও আমাদের অবস্থান দুর্বলই থাকবে। কারণ বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রের মর্যাদা নির্ভর করে তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা, প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরতা ও জনগণের মধ্যে দেশপ্রেমের মানসিকতার ওপর। এগুলোর অভাব মানেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও অসহায়ত্ব।
শুধু সরকারি পদক্ষেপেই সব হবে না, প্রয়োজন একটি ‘ন্যাশনাল কনসেন্সাস’। প্রতিরক্ষা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে গণআলোচনা, শিক্ষার্থী ও তরুণদের মধ্যে সচেতনতা, প্রযুক্তিখাতে দেশীয় উদ্যোগকে উৎসাহ দেওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা ফান্ড তৈরি করা—এসব হতে পারে প্রথম ধাপ।
আজকের দিনে আমরা যদি সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ না করি, আগামী প্রজন্মের সামনে রেখে যাব শুধুই অনুশোচনা। একটা প্রবাদ আছে—যে জাতি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, সে জাতিকে বারবার সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখতে হয়।
আমরা যদি অন্তত এমন একটা দেশ হতে পারি, যার প্রতিরক্ষারূপে শত্রু দুবার চিন্তা করে, তবে সেটাই হবে প্রকৃত বিজয়। কেননা প্রতিরক্ষা মানে যুদ্ধ নয়, যুদ্ধকে প্রতিহত করার ক্ষমতা। সেটি অর্জন করলেই আর কেউ প্রশ্ন তুলবে না—‘ভারত আক্রমণ করলে কয় ঘণ্টা টিকতে পারবা?’ বরং তখন প্রশ্ন হবে—‘তাদের সাহস হয় কী করে তোমাদের দিকে চেয়ে দেখার?’
আপনার মতামত জানানঃ