বাংলাদেশের পরমাণু বিজ্ঞানীরা আজকাল গবেষণার জগৎ থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে যেন খাদ্য নিরাপত্তার প্রহরীতে পরিণত হয়েছেন। যাদের মূল কাজ হওয়ার কথা ছিল ভবিষ্যতের প্রযুক্তি উদ্ভাবন, তারা এখন ব্যস্ত দেশের বন্দরে বন্দরে আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত করতে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ হয়, তা শুনলে রীতিমতো বিস্মিত হতে হয়। একজন পরমাণু বিজ্ঞানীর জন্য বছরে মাত্র ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ! আধুনিক গবেষণা কিংবা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অর্জনের পথে যা নিঃসন্দেহে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বাজেট বিশ্লেষণ বলছে, গত পাঁচ বছরে মোট বরাদ্দ ছিল প্রায় ১,২২৬ কোটি টাকা। কিন্তু এর অর্ধেকের বেশি গেছে বেতন-ভাতায়। গবেষণায় মাত্র ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, যার মধ্যে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩ কোটি। গবেষণার এই টুকরো টাকায় কেবল সংখ্যা গোনাই সম্ভব, গবেষণার মানোন্নয়ন নয়।
অথচ এই কমিশনের অধীনে কাজ করছেন প্রায় দেড়শ পিএইচডিধারী বিজ্ঞানী। যাদের কেউ কেউ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেছেন। তারা এখন খাদ্যপণ্যে তেজস্ক্রিয় উপাদান শনাক্ত করার মতো দায়িত্বে নিযুক্ত, যা এক অর্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিজ্ঞানচর্চার অপচয় বললে ভুল হবে না।
অপরদিকে, বিদেশি প্রশিক্ষণ বা জ্ঞান বিনিময়ের সুযোগ যেটা মূলত বিজ্ঞানীদের জন্য হওয়া উচিত ছিল, তা চলে গেছে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের হাতে। গত এক বছরে অন্তত দুই ডজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ‘প্রশিক্ষণের’ নামে বিদেশ সফরে গেছেন, যাদের কারও ব্যাকগ্রাউন্ড বিজ্ঞানের সঙ্গে সামান্যতম সম্পর্কও নেই। এই তালিকায় উপসচিব থেকে শুরু করে যুগ্ম সচিব পর্যন্ত রয়েছেন। বিজ্ঞানীদের জায়গা দখল করে বিদেশে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে তারা একরকম রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ই করছেন।
এই অবস্থার মধ্যে পরমাণু শক্তি কমিশন যদিও কিছু আয় করতে পেরেছে। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গবেষণা ও খাদ্য পরীক্ষার মাধ্যমে কমিশন প্রায় ৬২ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। একই সময়ে ১০টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, গবেষণায় ৬১ জন গবেষককে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে এটি যথেষ্ট নয়—সামগ্রিক চিত্র এখনও হতাশাব্যঞ্জক।
আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এখন খাদ্য পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা বাতিলের চিন্তা করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ১২ বছরের পরীক্ষা রিপোর্ট চেয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। এমনকি পরমাণু শক্তি কমিশন যখন সংবাদমাধ্যমে তাদের অবস্থান তুলে ধরে বিবৃতি দেয়, তখন কমিশনের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেয় মন্ত্রণালয়।
এটা শুধু বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের অপমান নয়, বরং দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার প্রতিও একপ্রকার অবহেলা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যেখানে আরও আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণা প্রয়োজন, সেখানে তা একরকম নাকচ করে দেওয়ার চেষ্টাই চলছে। অথচ আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যে মাঝে মাঝেই তেজস্ক্রিয় উপাদান পাওয়া যাচ্ছে—এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ বলেন, “খাদ্যে তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়া মানে দেশের মানুষের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া।” তিনি একেবারে ঠিক বলেছেন। একটি রাষ্ট্র যদি তার বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার ভিতকে দুর্বল করে ফেলে, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, প্রযুক্তিগতভাবে পেছিয়েও পড়বে।
ভারত কিংবা পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো যেখানে হাজার কোটি টাকা গবেষণায় ব্যয় করে, বাংলাদেশ সেখানে বরাদ্দ দেয় হাতে গোনা কিছু টাকা। এই আর্থিক ব্যবধান কেবল অর্থনৈতিক নয়, নীতিগতও বটে। রাষ্ট্রযন্ত্র যদি গবেষণার গুরুত্ব না বোঝে, তবে উন্নয়নের ভাষা কেবল উন্নয়নশীল হওয়ার কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরা আজ একধরনের মনস্তাত্ত্বিক ক্লান্তি ও অবমূল্যায়নের ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। যখন তাঁরা দেখেন, তাঁরা না পেয়েও চেষ্টা করে যাচ্ছেন আর যাঁরা কিছুই করেন না, তাঁরা প্রশংসা ও সুযোগের কেন্দ্রে, তখন সেই জাতির জন্য এর চেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা আর হতে পারে না।
সাধারণ মানুষ জানতেও পারছে না, এই বিজ্ঞানীরাই চুপচাপ রক্ষা করছেন তাদের খাবার টেবিল। আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যে তেজস্ক্রিয়তা থেকে শুরু করে বিষাক্ত কেমিক্যালের অস্তিত্ব শনাক্ত করছেন, অথচ সেই দায়িত্বকেই এখন রাষ্ট্র মনে করছে অনাবশ্যক। খাদ্যপণ্য পরীক্ষা তুলে নেওয়ার অর্থ শুধু বিজ্ঞানীদের প্রতি অবিচার নয়, বরং দেশের নাগরিকদের মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া।
এভাবে চলতে থাকলে, বাংলাদেশ হয়তো অদূর ভবিষ্যতে কোনো এক মারাত্মক স্বাস্থ্য দুর্যোগে আক্রান্ত হবে, যার সূত্রপাত হবে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্য আমদানির মধ্য দিয়ে। সেই দিন আর বেশি দূরে নয়, যদি এখনই বিজ্ঞান, গবেষণা ও নিরাপত্তার প্রতি রাষ্ট্র সচেতন না হয়।
আপনার মতামত জানানঃ