বাংলাদেশ বর্তমানে এমন এক ভূরাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে অবস্থান করছে, যেখানে একদিকে রয়েছে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, অন্যদিকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদ, পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক মেরুকরণের নতুন ধারা। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে অধিকাংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র তাদের সামরিক শক্তি বাড়াতে ব্যস্ত। অথচ বাংলাদেশ বিপরীত পথে হাঁটছে। যদিও সামরিক বাজেট টাকার অংকে বেড়েছে, ডলারের মূল্যে তা প্রকৃত অর্থে কমে গেছে। এর অধিকাংশ ব্যয় হচ্ছে সেনানিবাস নির্মাণ, হাসপাতাল, অডিটোরিয়াম ও প্রশিক্ষণ ভবন তৈরির মতো অবকাঠামোতে। ফলে অস্ত্র ও যুদ্ধসামগ্রী কেনায় বরাদ্দ কমে যাচ্ছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অস্ত্র আমদানি আগের পাঁচ বছরের তুলনায় প্রায় ৪৮ শতাংশ কমেছে। ২০১৯ সালে যেখানে বাংলাদেশ ৭১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের অস্ত্র আমদানি করেছিল, ২০২২ সালে তা দাঁড়ায় মাত্র ১৮ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। এমন প্রবণতা একটি সামরিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ও কৌশলগত অগ্রাধিকার নির্ধারণে অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দেয়।
অপরদিকে ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে রামু, বরিশাল, মিঠামইন ও লালমনিরহাটে নতুন ক্যান্টনমেন্ট ও সামরিক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। তবে এসব অবকাঠামো চাকচিক্য বাড়ালেও প্রতিরক্ষার মূল ভিত্তি—ডেটরেন্স বা প্রতিরোধ ক্ষমতা—দৃঢ় হয়নি। মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর এ অবস্থাকে “ফাঁকা জৌলুস” বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, বাজেট যেহেতু পরিচালন ও নির্মাণ ব্যয়ে চলে যায়, তাই অস্ত্রায়ণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জায়গায় কোনো নজরই থাকে না। তিনি তুলনামূলক দৃষ্টান্ত হিসেবে পাকিস্তানকে টেনে এনেছেন—যাদের জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে কম হলেও প্রতিরক্ষা ব্যয় অনেক বেশি।
ফজলে এলাহীর মতে, সামরিক ডেটরেন্স ছাড়া কোনো দেশ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সম্মানজনক অবস্থান অর্জন করতে পারে না। তার উদাহরণ অনুযায়ী, ৯০-এর দশকে বাংলাদেশ যেভাবে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে, বর্তমানে সেই রকম সামরিক দৃঢ়তা আর দেখা যায় না। কারণ, আজ আর বাংলাদেশের সামরিক শক্তি প্রতিবেশীদের কাছে ‘ডেটরেন্স’ হিসেবে গণ্য হয় না।
আরেক বিশেষজ্ঞ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসেন আরও খোলাসা করে বলেছেন, বাজেটে টাকার অংকে বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকৃত সামরিক উন্নয়ন হয় না যদি সেই বাজেট থেকে হাই ভ্যালু অস্ত্র বা যুদ্ধবিমান কেনার ব্যবস্থা না থাকে। তার মতে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ এমন কোনো আধুনিক অস্ত্র বা প্রযুক্তি সংগ্রহ করেনি যেটা ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, সরকার আদৌ সামরিক আধুনিকায়নের সদিচ্ছা রাখে কিনা।
বাংলাদেশের অস্ত্র আমদানির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণেও এই ধারা স্পষ্ট। ২০১৫ সালে যেখানে অস্ত্র আমদানিতে খরচ হয়েছিল ৬৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার, সেখানে ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারে। এরপর ২০১৯ সালে কিছুটা বাড়লেও পরবর্তী বছরগুলোতে আবার কমতে থাকে। ২০২২ সালে অস্ত্র আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এসব থেকে বোঝা যায়, সামরিক আধুনিকীকরণে কোনো ধারাবাহিকতা বা পরিকল্পনা নেই।
এসব অস্ত্র আমদানির মধ্যে ৭৪ শতাংশই এসেছে চীন থেকে, যা একটি নির্ভরশীল সম্পর্ককে তুলে ধরে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য ও তুরস্ক। কিন্তু এই আমদানি হ্রাস ও একতরফা সরবরাহ-নির্ভরতা প্রতিরক্ষা নীতিতে বৈচিত্র্য ও কৌশলগত বিকল্পের অভাব দেখায়।
মাহমুদ হোসেন আরও বলেন, ভবিষ্যতের সামরিক শক্তি শুধু অস্ত্রের ওপর নির্ভর করবে না, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং এবং উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক বিজ্ঞান হবে মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু এই প্রযুক্তিনির্ভরতার দিকেও বাংলাদেশ এখনো তেমন নজর দেয়নি। তিনি বলেন, সায়েন্টিফিক টেকনোলজিক্যাল ভ্যালু বা প্রযুক্তিনির্ভর সামরিক উদ্ভাবনে যেসব দেশ এগিয়ে গেছে—যেমন তুরস্কের ড্রোন প্রযুক্তি—বাংলাদেশ সেখানে অনেক পিছিয়ে।
এতসব আলোচনার পেছনে যে বার্তাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো—বাংলাদেশ তার ভূরাজনৈতিক অবস্থান, জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিবেচনায় ‘ছোট দেশ’ নয়। কিন্তু প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিকল্পনায় দেশের অবস্থান বারবার ক্ষুদ্রকায় ভাবনায় আটকে যাচ্ছে। সামরিক অবকাঠামো থাকলেও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা, কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে নজর না দিলে ভবিষ্যতের জাতীয় নিরাপত্তা জোরালোভাবে হুমকির মুখে পড়তে পারে।
অতএব, সামরিক বাজেট বৃদ্ধিকে কেবল ক্যান্টনমেন্ট বা ভবনের সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যায়ন না করে, সত্যিকার অর্থে যুদ্ধ-প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকেই এখন মনোযোগ দিতে হবে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নীতিগত সিদ্ধান্ত ও কৌশলগত দিকনির্দেশনার অভাব পূরণ না হলে, চাকচিক্যের আড়ালে বাস্তব শক্তির অভাব স্পষ্ট হয়ে পড়বে—যার কুফল আগামী দিনের কূটনীতি ও নিরাপত্তায় গুরুতর হয়ে উঠতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ