মানবজাতির হাজার বছরের সবচেয়ে রহস্যময় প্রশ্ন—“আমরা কি মহাবিশ্বে একা?”—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা যুগের পর যুগ ধরে মহাকাশে চোখ রেখে চলেছেন। আর সেই দীর্ঘ অভিযাত্রায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে এক রোমাঞ্চকর আবিষ্কার, যা শুধু মহাকাশ বিজ্ঞানেই নয়, মানুষের কল্পনাকে নাড়া দিচ্ছে গভীরভাবে। কানাডার মনট্রিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একদল মহাকাশের এক কোণায় খুঁজে পেয়েছেন এমন এক গ্রহ, যার বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সঙ্গে মিল রাখে। এর নাম এল ৯৮-৫৯এফ—যা ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে ‘সুপার আর্থ’ নামে।
এই ‘সুপার আর্থ’ অবস্থিত এক লাল বামন তারার চারপাশে, যার নাম এল ৯৮-৫৯। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৩৫ আলোকবর্ষ। শব্দটা শুনতে ছোট মনে হলেও, বাস্তবে এই দূরত্ব অনুধাবন করতে গেলে আমাদের কল্পনাকেও ফাঁকি দিতে হয়। তবে যেটি আশাব্যঞ্জক তা হলো—এই গ্রহটি রয়েছে তারার এমন একটি অঞ্চলে, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘হ্যাবিটেবল জোন’, অর্থাৎ এমন এক জায়গা যেখানে তাপমাত্রা ও অবস্থান এমন যে, সেখানে তরল পানি থাকতে পারে। তরল পানির অস্তিত্ব মানেই সেখানে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা।
গবেষকদের মতে, এই নতুন গ্রহের ভর পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ২.৮ গুণ বেশি এবং এটি একটি প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে তারাকে প্রদক্ষিণ করে—যা পৃথিবীর মতোই নিরবচ্ছিন্ন শক্তি গ্রহণের উপযোগী। এমনকি গ্রহটিতে যদি বায়ুমণ্ডল থাকে, তবে সেখানে থাকতে পারে কার্বন ডাই-অক্সাইড, জলের কণা এবং জীবনের উপস্থিতির সম্ভাব্য রাসায়নিক সংকেত—যা বিজ্ঞানীরা ‘biosignatures’ বলে চিহ্নিত করেন।
এই আবিষ্কার একদিনে হয়নি। ২০১৯ সালে নাসার মহাকাশ টেলিস্কোপ এই তারাটিকে কেন্দ্র করে প্রথম তিনটি গ্রহ খুঁজে পায়। এরপর ইউরোপিয়ান সাদার্ন অবজারভেটরি আরও একটি গ্রহ চিহ্নিত করে। আর সর্বশেষ আবিষ্কারটি—এই সুপার আর্থ—সম্পন্ন করেছেন মনট্রিয়ালের ট্রোটিয়ের ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ অন এক্সোপ্লানেটস (IREX)-এর গবেষকরা। এই পঞ্চম গ্রহটির গুরুত্ব অনেক বেশি, কারণ এটি অবস্থান করছে ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রাণ জন্ম নিতে পারে।
গবেষণার প্রধান লেখক ক্যাডিয়ু বলেন, “এল ৯৮-৫৯ গ্রহপুঞ্জ নিয়ে এটাই আমাদের সবচেয়ে পরিপূর্ণ চিত্র। এটি প্রমাণ করে, পৃথিবী ও মহাকাশ থেকে সংগৃহীত তথ্য একত্রিত করে আমরা ভবিষ্যতের কল্পনাগুলো বাস্তবে রূপ দিতে পারি।” এই গ্রহটি এখন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের লক্ষ্যবস্তুর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ওয়েব টেলিস্কোপের উচ্চ ক্ষমতা হয়তো একদিন আমাদের হাতে তুলে দেবে এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলের বিশ্লেষণ এবং সেখানকার পরিবেশের আরও সুস্পষ্ট ধারণা।
IREX-এর পরিচালক রেনে দোয়ঁ এই আবিষ্কারকে এক প্রাকৃতিক পরীক্ষাগারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর মতে, এল ৯৮-৫৯ গ্রহপুঞ্জের বৈচিত্র্য আমাদের শেখায়—কিভাবে সুপার আর্থ এবং সাব নেপচুন গ্রহগুলো গঠিত হয়, কীভাবে তারা বায়ুমণ্ডল ধরে রাখে, এবং ক্ষুদ্র তারার চারপাশে কেমন করে গ্রহের জন্ম হয়। এক কথায়, এটি মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে একটি আদর্শ গবেষণার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
এই গবেষণার বিস্তারিত প্রতিবেদন খুব শিগগিরই The Astronomical Journal-এ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে “Detailed Architecture of the L 98-59 System and Confirmation of a Fifth Planet in the Habitable Zone” শিরোনামে।
তবে প্রশ্নটা এখানেই শেষ নয়। এই গ্রহে সত্যিই কি প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে? যদি থেকে থাকে, তবে সেটা কি আমাদের মতো? না কি সম্পূর্ণ ভিন্ন জৈব কাঠামোর ওপর গড়ে ওঠা প্রাণীজগৎ? আমরা কি সেখানে যেতে পারব একদিন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনও সময়ের কাছে গোপন। তবে এই আবিষ্কার একটি জিনিস নিশ্চিত করে—আমরা যে মহাবিশ্বে একা নই, তার ইঙ্গিত হয়তো খুব কাছেই।
আজ থেকে ৫০০ বছর আগে যেমন মানুষ ভাবতে পারেনি, তারা এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে কয়েক ঘণ্টায় উড়ে যেতে পারবে, আজ আমরা ঠিক তেমনই এক সম্ভাবনার দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। যেখান থেকে শুরু হতে পারে এক নতুন মহাকাশযাত্রা, এক নতুন ইতিহাস— যেখানে পৃথিবী হয়তো আর একমাত্র জীবনের আঁতুড়ঘর থাকবে না। এই আবিষ্কার সেই ইতিহাসের ভূমিকা মাত্র।
আপনার মতামত জানানঃ