
শরীফ ওসমান হাদি—বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই নামটি এমন এক সময়ে আলোচনায় এসেছে, যখন দেশটির রাজনীতির তাপমাত্রা তীব্রতম অবস্থায় পৌঁছেছে। আজ ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ দুপুরে ঢাকা শহরের পল্টন-বিজয়নগর এলাকায় তিন জন দুর্বৃত্ত মোটরসাইকেলে চড়ে এসে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে তাকে গুরুতরভাবে আহত করে, এবং সেই আঘাতে তার জীবন সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়ে গেছে। হাদি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন—দুর্বৃত্তদের গুলিতে আক্রান্ত এই রাজনৈতিক কর্মীর উপুড় হয়ে থাকা খবরটি সংবাদ শিরোনামেই জায়গা করে নিয়েছে, এবং তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে এক গভীর আন্দোলন ও বিতর্কের সূচনা করেছে।
ওসমান হাদি, মূলত রাজনীতির কোনো পুরনো শিখরে থাকা ব্যক্তিত্ব না হলেও, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম মুখ হিসেবে দ্রুতই একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক উপস্থিতি তৈরি করেছেন। তিনি ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ নামক সংগঠনের মুখপাত্র ও এক ধরনের জননেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন, যেখানে দাবি করা হয় “সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো,” “গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বাড়ানো,” এবং “ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র” গঠনের লক্ষ্যে কাজ করা। তার বক্তৃতা ও বক্তব্যে প্রচারিত হয়েছে যে বাংলাদেশে রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের অভাব দূর করতে হলে প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে নতুন ধারার প্রয়াস দরকার।
হাদির রাজনৈতিক পরিচয়টিও এই প্রেক্ষাপটে পড়ে; তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিষয়ের শিক্ষা নিয়েছেন এবং তরুণ নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা করছেন। ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীরা ও সমর্থকরা তাকে ব্যাখ্যা করেন যেন ‘একটি নতুন প্রজন্মের কণ্ঠস্বর,’ যারা পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর সীমাবদ্ধতা ও জনগণের অবিচারের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রশ্ন তুলছেন। এই প্রতিনিধিত্বের কারণে তিনি ২০২৫ সালের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করার ঘোষণা দেন।
এই প্রেক্ষাপটেই ১২ ডিসেম্বর ঘটে যাওয়া গুলির ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নকে সামনে এনে দিয়েছে। ঘটনার সময় হাদি জুমার নামাজের পর বিজয়নগরে Box Culvert রোডে ছিলেন, যখন মোটরসাইকেল থেকে দুই/তিন জন দুর্বৃত্ত তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় এবং আমরা এখন জানতে পারছি যে ঘটনাস্থল থেকেই পালিয়ে যায় তারা। গুলির আঘাত তার মাথার দিকে গিয়ে লাগে, এবং তা পরবর্তী চিকিৎসায় তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। ডাক্তাররা বলছেন যে তার অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন এবং তিনি লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন।
এই হামলা শুধু একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর আক্রমণের ঘটনা নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনীতির মৌলিক প্রশ্নগুলোকে আরও জোরালো করে দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ঠিক পরদিন এই ধরনের সহিংস ঘটনা একটি “অশনিসংকেত” ডেকে আনা হয়েছে, যা দেশে রাজনৈতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও নির্বাচনের পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দেশে নির্বাচন প্রায় সময়েই উত্তেজনার মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে, কিন্তু প্রার্থীর ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালানো, তা আবার রাজধানীর খুব ব্যস্ত ও প্রকাশ্য জায়গায় — এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
হাদির ওপর হামলার ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোও প্রকাশ্যে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে এবং এর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছে যে প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব, এবং এমন বিপজ্জনক ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা ছাড়া কোনো পথ নেই। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও তীব্রভাবে এই হামলাকে নিন্দা জানিয়েছেন এবং এটিকে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় সরাসরি আঘাত বলে অভিহিত করেছেন।
ছোট রাজনীতির সংগঠনগুলোও তাদের অবস্থান দিয়েছেন। অনেকে এটিকে ভোটের পরিবেশকে ব্যাহত করার একটি প্রকাশ্য প্রচেষ্টা বলে মন্তব্য করেছেন, যেখানে প্রার্থীর বিশুদ্ধ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বদলে সহিংসতা ব্যবহার করা হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মন্তব্য করেছে যে হাদির ওপর হামলা গণতন্ত্র, আইন-শৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত, এবং নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এমন পরিস্থিতিকে নির্বাচন আলোচনাকে বানচাল করতে বেপরোয়া শক্তির অপচেষ্টা বলে অভিহিত করেছে।
এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে “নিরাপত্তাহীনতা” ও “ভয়াবহতার অনুভূতি”কে পুনরায় জীবন্ত করে তুলেছে। যখন একটি রাজনৈতিক কর্মী নিজেই এমন পরিস্থিতির শিকার হতে পারে, তখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অনিশ্চয়তা প্রকটভাবে সামনে আসে। অনেকে বলছেন, নির্বাচনের পরিবেশে ভোট দিতে আগ্রহী ও নির্দ্বিধায় অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী জনগণের মধ্যে এই ধরনের সহিংস ঘটনা আতঙ্ক সৃষ্টি করবে এবং অনেকেই রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এটি শুধু রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা নয়; এটি একটি দীর্ঘসূত্রী সংকটের প্রকাশ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবন কখনোই পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ ছিল না, বরং তা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিভাজন, বিরোধ, এবং বনোদ্বেগের মধ্য দিয়ে এসেছে। এই ধরনের হামলা যদি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা মতাদর্শগত ভিন্নমতের কারণে ঘটে থাকে, তাহলে এর ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। কিন্তু যদি এটি নির্বাচনের পরিবেশকে ভয়ভীতি মূলকভাবে প্রভাবিত করতে করা হয়, তবে এটি দেশটির সামগ্রিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আরও দুর্বল করবে।
হাদির নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে যদি দেখা হয়, তিনি বরাবরই পুরনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর সমালোচনা করেছেন এবং বলেছেন যে বাংলাদেশে নতুন ধরনের রাজনীতি প্রয়োজন, যেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কার, স্বচ্ছতা ও নাগরিক অংশগ্রহণ বেশি থাকবে। তার বক্তব্যগুলো মাঝে মাঝে প্রচলিত রাজনীতির ধারা থেকে আলাদা, এবং কিছু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন হাদি তিনি নিজেই একটি নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করছেন—একজন তরুণ নেতা যারা পুরনো রাজনীতির বাইরে একটি নতুন রাজনৈতিক মাত্রা তৈরি করতে চাইছেন।
হাদির ওপর হামলার ঘটনাটি ভবিষ্যতের নির্বাচনের জন্যও বড় ইঙ্গিত বহন করে। নির্বাচন কমিশন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি ব্যবস্থা যদি নির্বাচনী পরিবেশের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে তার ফল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দর্শকপদ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নজর কাড়ে। অনেকেই বলছেন যে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে সকল প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অন্যতম মৌলিক বিষয়, এবং এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না থাকলে জনগণের বিশ্বাস ও ভোটের মূল্যহীন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
একই সময়ে এই ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই হাদির পাশাপাশির মতাদর্শের প্রতি সমর্থন জানানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। অন্যরা মন্তব্য করেছেন যে দেশের রাজনীতিতে সহিংসতা ও হুমকি কোনোভাবেই রাজনৈতিক আলোচনায় স্থান পেতে পারে না—এই ধরনের ঘটনা রাজনীতির স্বাভাবিক ধারাকে ব্যাহত করে, এবং তা জনতার ভরসাকে ক্ষুণœ করতে পারে।
তবে এটি বলা ঠিক হবে যে হাদি-হামলার ঘটনাটি শুধু একটি ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনের একটি মোড়ঘেঁষা ঘটনা যেখানে ভোট, নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক অধিকার, এবং মতাদর্শগত স্বাধীনতা—এসব প্রশ্ন পুনরায় আলোচিত হচ্ছে। দেশজুড়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত, তরুণ রাজনীতিকদের আগমন এবং নির্বাচন-সংক্রান্ত উত্তেজনা—সব মিলিয়ে এই ঘটনাটি একটি বড় রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদি আহত হওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গণে এই প্রশ্ন উঠেছে যে: ভবিষ্যৎ নির্বাচনে কি নিরাপদ?
আপনার মতামত জানানঃ