ভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন দুপুরে বিজয়নগরের ব্যস্ত সড়কে যে গুলির শব্দ শোনা গেল, তা মুহূর্তেই কেবল একজন মানুষকে নয়, দেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক উত্তাল বাস্তবতাকেও নতুন করে সামনে নিয়ে আসে। রিকশায় বসে থাকা শরীফ ওসমান বিন হাদিকে লক্ষ্য করে মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলি ঢাকার রাজনীতিতে আরেকটি অস্থির অধ্যায় যুক্ত করে দেয়। মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়, তখন তার অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন এই মানুষটির নাম তখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, রাজনৈতিক অঙ্গন আর সাধারণ মানুষের আলোচনায়—কে এই ওসমান হাদি, কেন তাকে গুলি করা হলো, আর এর অর্থ কী?
শরীফ ওসমান বিন হাদি সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতিতে হঠাৎ করে উঠে আসা কোনো নাম নন, আবার দীর্ঘদিনের পরিচিত মূলধারার রাজনীতিকও নন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তার নামটি পরিচিত হতে শুরু করে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর হাত ধরে। এই প্লাটফর্ম নিজেকে উপস্থাপন করেছে সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আহ্বান নিয়ে। রাজনীতির ভাষায় যা অনেকের কাছে কঠোর, অনেকের কাছে আবার স্পষ্ট ও আপসহীন বলে মনে হয়েছে। সেই ভাষা, সেই অবস্থানই হয়তো তাকে এনে দিয়েছে সমর্থন, আবার তৈরি করেছে প্রবল বিরোধিতাও।
ঝালকাঠির নলছিটিতে জন্ম নেওয়া হাদির শৈশব কেটেছে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাজীবনের মধ্য দিয়ে। বাবা ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসায় পড়াশোনার শুরু, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়া—এই পথচলা তাকে এনে দেয় ভিন্ন দুই জগতের অভিজ্ঞতা। মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হওয়া, ভাষা ও পোশাকের ধরন—এসব কারণে এক সময় তাকে ঘিরে নানা সন্দেহও ছিল। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি কি ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত? সহকর্মী ও কাছের মানুষদের দাবি অবশ্য ভিন্ন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন না। বরং তিনি যুক্ত ছিলেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে, লিখেছেন একাধিক বই, শিক্ষকতা করেছেন সাইফুরসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস নামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হাদির জীবনে এক বড় বাঁক এনে দেয়। রাজপথে তার উপস্থিতি, বক্তৃতার ভাষা, রাষ্ট্র ও ক্ষমতার কাঠামো নিয়ে তার প্রশ্নগুলো তাকে পরিচিত করে তোলে নতুন প্রজন্মের এক অংশের কাছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চ গড়ে ওঠে তার নেতৃত্বে। এই মঞ্চ কেবল রাজনৈতিক বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; সাংস্কৃতিক আয়োজন, আলোচনা সভা, জনসংযোগ—সব মিলিয়ে এটি এক ধরনের বিকল্প রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করার চেষ্টা করেছে। ডাকসু নির্বাচনে শিবির নেতৃত্বাধীন প্যানেল থেকে ইনকিলাব মঞ্চের ফাতিমা তাসনিম জুমা মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা এই মঞ্চের প্রভাব নিয়ে নতুন আলোচনা তৈরি করে।
হাদির রাজনৈতিক বক্তব্য বরাবরই তীব্র। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল প্রকাশ্য ও কঠোর। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর তিনি যে মন্তব্য করেন—এটি পুরো পৃথিবীর জন্য নজির—তা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। আবার তিনি বিএনপি প্রসঙ্গেও বলেছেন, তারা যদি ‘পুরনো ধারায়’ রাজনীতি করে ক্ষমতায় আসে, তবে দুই বছরের বেশি টিকতে পারবে না। সেনাবাহিনী নিয়েও সমালোচনা করেছেন তিনি, প্রশ্ন তুলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা ও দৃশ্যমান পরিবর্তনের ঘাটতি নিয়ে, প্রস্তাব দিয়েছেন একটি জাতীয় সরকার গঠনের। এসব বক্তব্য তাকে একদিকে করে তুলেছে আলোচিত, অন্যদিকে বিতর্কিত।
চলতি বছরে এনসিপির ডাকা মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচিতে সংঘর্ষের পর হাদির দেওয়া বক্তব্য নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। গোপালগঞ্জ জেলা ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে দেওয়া তীব্র ভাষার বক্তৃতা সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। পরে বিতর্কের মুখে তিনি তার বক্তব্যকে ‘মুক্তির মহাকাব্য’ বলে ব্যাখ্যা করেন এবং কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে দুঃখ প্রকাশ করেন। এই ঘটনাগুলো দেখিয়েছে, তার ভাষা যেমন সমর্থকদের উজ্জীবিত করে, তেমনি বিরোধীদের ক্ষুব্ধও করে তোলে।
গত নভেম্বর মাসে হাদি নিজেই জানান, তিনি দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছেন। তার দাবি অনুযায়ী, শুধু তাকেই নয়, তার পরিবার—মা, বোন, স্ত্রী—সবাইকে নিয়ে ভয়ংকর হুমকি দেওয়া হয়েছে। ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার হুমকি, ধর্ষণের ভয় দেখানো—এই সবকিছু তিনি ফেসবুকে লিখে জানান। সেই পোস্টে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ সমর্থকরা তাকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছে। জীবননাশের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও তিনি ‘ইনসাফের লড়াই’ থেকে সরে যাবেন না—এই ঘোষণাও দেন। সেই পোস্ট এখন ফিরে দেখা হচ্ছে নতুন করে, গুলির ঘটনার পর।
ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা ছিল হাদির রাজনৈতিক যাত্রার আরেকটি বড় ধাপ। মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, রমনা ও শাহবাগ থানা এলাকা নিয়ে গঠিত এই আসনে তিনি প্রতি শুক্রবার জনসংযোগ করতেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলা, লিফলেট বিতরণ—এসব ছিল তার নিয়মিত কর্মসূচি। ঘটনার দিনও জুমার নামাজের পর মসজিদে লিফলেট বিলির কথা ছিল। কর্মসূচি শেষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হয়ে আলোচনা ও দুপুরের খাবারের পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনাই ভেঙে যায় মুহূর্তের মধ্যে, যখন খবর আসে—হাদিকে গুলি করা হয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেলে আসা হামলাকারীরা গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, রিকশায় বসা অবস্থায় খুব কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. ফারুক জানান, মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে জরুরি বিভাগে আনা হয় এবং তার অবস্থা ছিল গুরুতর। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য ইসরাফিল বলেন, সবাই দোয়া চাইছেন—এই মানুষটির জন্য, যিনি এখন জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
এই গুলির ঘটনা দ্রুত রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ছাত্রদলের সভাপতি নাসির উদ্দিন নাসির এক ফেসবুক পোস্টে ঘটনাটির নিন্দা জানিয়ে বলেন, তফসিল ঘোষণার ঠিক পরের দিনেই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র। তিনি হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি হাদির দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তার সক্রিয় ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও সামনে আসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতার পুরোনো ছায়া। ভিন্নমত, তীব্র ভাষা, বিকল্প রাজনৈতিক অবস্থান—এসব কি এখনো নিরাপদ নয়? একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী, যিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের বাইরে রেখে কথা বলতে চেয়েছেন, তার ওপর এই হামলা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এটি কি কেবল একজন ব্যক্তির ওপর আক্রমণ, নাকি একটি বার্তা—রাজনীতির মাঠে নির্দিষ্ট সীমার বাইরে গেলে তার মূল্য দিতে হয়?
হাদির সমর্থকদের কাছে তিনি এক ধরনের প্রতীক। কেউ তাকে দেখেন আপসহীন কণ্ঠস্বর হিসেবে, কেউ দেখেন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের নতুন মুখ হিসেবে। আবার সমালোচকদের চোখে তিনি উসকানিমূলক ভাষার ব্যবহারকারী, যিনি অযথা উত্তেজনা তৈরি করেন। এই দুই বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি এখন হাসপাতালের শয্যায়, যেখানে রাজনীতির কোনো স্লোগান নেই, আছে কেবল বেঁচে থাকার লড়াই।
গুলির ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার পুরোনো বক্তব্য, ভিডিও, পোস্ট—সবকিছু নতুন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ বলছেন, তার ভাষাই তাকে বিপদের মুখে ফেলেছে। কেউ বলছেন, কোনো ভাষাই গুলির জবাব হতে পারে না। এই বিতর্কের মধ্যেই একটি প্রশ্ন ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে—ভোটের তফসিল ঘোষণার পর এমন একটি ঘটনা কি নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি করছে না?
শরীফ ওসমান বিন হাদি এখনো আইসিইউতে। তার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ভূমিকা অনিশ্চিত, এমনকি তার জীবনও। কিন্তু তার ওপর হামলার ঘটনাটি ইতিমধ্যে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। এটি মনে করিয়ে দিচ্ছে, বাংলাদেশে রাজনীতি শুধু বক্তব্য আর কর্মসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এখানে জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়ে যেতে পারে। এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়—এই দেশ কি এমন এক রাজনীতির দিকে এগোচ্ছে, যেখানে ভিন্ন কণ্ঠকে গুলি দিয়ে থামানোর চেষ্টা করা হয়? নাকি এই ঘটনাই আবার নতুন করে নিরাপত্তা, সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক পরিসর নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে রাষ্ট্র ও সমাজকে?
হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা তাই কেবল একটি খবর নয়, এটি একটি আয়না—যেখানে বর্তমান রাজনীতির ভয়, উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই আয়নায় তাকিয়ে দেশ কী দেখবে, আর কী শিখবে—সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আপনার মতামত জানানঃ