কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তে আট দিন ধরে এক অদ্ভুত নীরবতা ছিল। সীমান্তের মাঠ, ঝোপঝাড়, কাঁটাতারের ফাঁকে ফাঁকে যে পথগুলো দিয়ে প্রতিদিন মানুষের যাতায়াত, সেই পথগুলোর প্রতিটিতেই ভাসছিল এক তরুণের অনুপস্থিতি। নাম তার শান্ত। বয়স মাত্র চব্বিশ। জীবনের শুরুটুকু ঠিকমতো পেরোতেই পারেনি, অথচ শেষটা এসে থামল সীমান্তের গুলিতে। আট দিন পর তার মরদেহ যখন পরিবারের হাতে পৌঁছাল, তখন সেই নীরবতা ভেঙে গেল কান্না আর দীর্ঘশ্বাসে।
শান্ত ছিল দৌলতপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী মোহাম্মদপুর ডাংয়েরপাড়া গ্রামের ছেলে। সীমান্তের খুব কাছেই তার বাড়ি। কাঁটাতারের বেড়া যেন তার জীবনের নিত্যসঙ্গী। ছোটবেলা থেকেই সে দেখেছে সীমান্তের টহল, অস্ত্রধারী মানুষ, রাতের অন্ধকারে চলাফেরা করা ছায়ামূর্তি। এই জীবন তার কাছে নতুন কিছু ছিল না। কিন্তু এই পরিচিত বাস্তবতার মধ্যেই এক রাতে ঘটে গেল এমন কিছু, যা তার পরিবারকে আজীবনের জন্য শূন্য করে দিল।
৫ ডিসেম্বর রাত। সময় আনুমানিক দেড়টা। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ তখন গভীর ঘুমে। বিজিবির ভাষ্য অনুযায়ী, ওই রাতে ১০ থেকে ১২ জন বাংলাদেশি ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টা করছিল। অভিযোগ, তারা মাদক পাচারের উদ্দেশ্যে সীমান্ত অতিক্রম করছিল। এ সময় বিএসএফ বাধা দেয়। পরিস্থিতি মুহূর্তেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বলা হয়, চোরাকারবারিরা বিএসএফ সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আত্মরক্ষার্থে বিএসএফও পাল্টা গুলি ছোড়ে। সেই গুলিতেই শান্ত আহত হয়।
এই বর্ণনার সঙ্গে শান্তর পরিবারের কষ্টের বর্ণনা মেলানো কঠিন। তাদের কাছে শান্ত শুধু একটি নাম নয়, সে ছিল পরিবারের ভরসা। বাবা শিপন আলী একজন সাধারণ মানুষ। সীমান্ত এলাকার মানুষের মতোই জীবন তার সংগ্রামে ভরা। শান্তই ছিল সেই ছেলে, যার কাঁধে ভবিষ্যতের কিছু দায়িত্ব তুলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বাবা-মা। কিন্তু গুলির শব্দ সেই স্বপ্নকে মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শান্তকে বিএসএফ আটক করে এবং চিকিৎসার জন্য ভারতের করিমপুর রুরাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সীমান্ত পেরিয়ে ছেলের আহত হওয়ার খবর যখন গ্রামে পৌঁছায়, তখন পরিবার ছুটে যাওয়ারও সুযোগ পায়নি। সীমান্তের নিয়ম, দুই দেশের আইনি জটিলতা, সব মিলিয়ে শান্ত তখন পরিবারের নাগালের বাইরে। তারা শুধু অপেক্ষা করেছে। অপেক্ষা আর উৎকণ্ঠা।
সেই অপেক্ষা দীর্ঘ হয়নি, কিন্তু নির্মম ছিল। ৫ ডিসেম্বর বিকালেই হাসপাতালেই শান্তর মৃত্যু হয়। তবে এই খবর পরিবার জানতে পারে অনেক পরে। সীমান্তে নিহত হওয়ার পরও মরদেহ ফিরতে সময় লাগে আট দিন। এই আট দিন যেন পরিবারের কাছে আট বছরের সমান। প্রতিটি দিন তারা কাটিয়েছে প্রশ্ন নিয়ে—ছেলে কি বেঁচে আছে? যদি না থাকে, তবে তাকে কবে শেষবারের মতো দেখতে পাবে?
অবশেষে শনিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। কুষ্টিয়া ৪৭ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সহকারী পরিচালক মো. জাকিরুল ইসলাম জানান, বিএসএফের গুলিতে নিহত শান্তর মরদেহ তার পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক ভাষায় এটি একটি সম্পন্ন কাজ, কিন্তু পরিবারের কাছে এটি ছিল জীবনের সবচেয়ে ভারী মুহূর্ত।
মরদেহ যখন গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়, তখন পুরো ডাংয়েরপাড়া থমকে যায়। যারা শান্তকে চিনত, যারা তার সঙ্গে মাঠে খেলেছে, যারা তাকে বাজারে যেতে দেখেছে—সবাই ছুটে আসে। সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোতে মৃত্যু নতুন কিছু নয়, কিন্তু তরুণ বয়সে এমন মৃত্যু সবাইকে নাড়া দেয়। বিশেষ করে যখন মৃত্যু আসে সীমান্তের গুলিতে, তখন প্রশ্নগুলো আরও তীক্ষ্ণ হয়।
শান্ত কি সত্যিই অপরাধী ছিল? নাকি সে সীমান্ত এলাকার আর দশজন তরুণের মতোই জীবিকার খোঁজে ঝুঁকিপূর্ণ পথে পা বাড়িয়েছিল? মাদক পাচারের অভিযোগ উঠলেই কি একটি প্রাণের মূল্য কমে যায়? এসব প্রশ্ন গ্রামের বাতাসে ভাসে, কিন্তু উত্তর মেলে না।
সীমান্ত এলাকার বাস্তবতা কঠিন। কাজের সুযোগ সীমিত, দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী। অনেক তরুণই ঝুঁকিপূর্ণ পথে পা বাড়ায়, কেউ ধরা পড়ে, কেউ ফিরে আসে, কেউ আর ফেরে না। শান্তর মৃত্যু সেই চক্রেরই আরেকটি করুণ পরিণতি। কিন্তু পরিবার এসব বিশ্লেষণ মানতে চায় না। তাদের কাছে শান্ত ছিল শুধু তাদের ছেলে।
বাবা শিপন আলীর চোখে এখন শুধু শূন্যতা। তিনি কথা বলতে গেলে বারবার থেমে যান। আট দিন ধরে ছেলের মরদেহের জন্য অপেক্ষা করেছেন, এখন সেই মরদেহই সামনে। মা নির্বাক। প্রতিবেশীরা তাকে সামলাচ্ছেন, কিন্তু মাতৃহৃদয়ের ক্ষত কি সামলানো যায়?
এই ঘটনা আবারও সীমান্তে প্রাণহানির বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গুলিতে নিহত হওয়ার খবর নতুন নয়। প্রতিবছরই এমন খবর আসে। প্রতিবারই আলোচনা হয়, প্রতিবাদ হয়, কিন্তু সীমান্তের বাস্তবতা খুব একটা বদলায় না। শান্তর মৃত্যু সেই ধারাবাহিকতারই আরেকটি নাম।
রাতের অন্ধকারে সীমান্তে কী ঘটেছিল, তা হয়তো পুরোপুরি জানা যাবে না। বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্য থাকবে, নথিতে তা লেখা থাকবে। কিন্তু গ্রামের উঠোনে শুয়ে থাকা মরদেহ সব বক্তব্যকে ছাপিয়ে যায়। শান্তর জীবনের গল্প সেখানেই থেমে গেছে।
শেষ পর্যন্ত শান্তকে দাফন করা হয় তার গ্রামের মাটিতে। সীমান্তের খুব কাছেই। যে সীমান্ত তার জীবনের বাস্তবতা ছিল, সেই সীমান্তই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল। কাঁটাতারের ওপারে এক দেশ, এপারে আরেক দেশ—এই বিভাজনের মাঝখানেই থেমে গেল এক তরুণের জীবন।
শান্তর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের শোক নয়, এটি সীমান্ত এলাকার অসংখ্য তরুণের অনিশ্চিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। আজ শান্ত, কাল হয়তো আরেকজন। যতদিন না সীমান্তে মানবিক সমাধান আসে, ততদিন এই গল্পগুলো লেখা হবে, বলা হবে, আর ভুলে যাওয়া হবে। কিন্তু ডাংয়েরপাড়ার একটি ঘরে শান্তর জন্য শোক কখনোই শেষ হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ