
দিল্লির শাহদরার সরু গলিগুলো রাত নামলেই নীরব হয়ে আসে। দিনের কোলাহল থেমে গেলে এখানকার ঘরগুলোয় জমে ওঠে অপেক্ষা, ক্লান্তি আর অনিশ্চয়তা। ঠিক এমনই এক রাতে নিশা আনসারির বুকের ভেতর জমে থাকা অপেক্ষা আজও শেষ হয়নি। রাত ন’টা বাজলেই তার মনে হয়, দরজার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কড়া নাড়ার শব্দ যেন কানে বাজে। মনে হয়, সাহিল বলছে—“আম্মি, দরজা খোলো, আমি চলে এসেছি।” নিশা জানেন, তার ছেলে আর এই পৃথিবীতে নেই। তবু মনের গভীরে একটা আশা এখনো লুকিয়ে থাকে। সেই আশাতেই তিনি রাত একটা পর্যন্ত জেগে বসে থাকেন, দরজার দিকে তাকিয়ে।
নিশা আনসারি বয়সে মাত্র ৪২। কিন্তু তার জীবনের অভিজ্ঞতা যেন বহু জীবনের সমান ভারী। গত পাঁচ বছরে তিনি হারিয়েছেন তার দুই ছেলেকে। বড় ছেলেটিকে ২০২০ সালে কেড়ে নিয়েছিল একটি মারাত্মক রোগ। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮। সেই ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই কয়েকদিন আগে গুলিতে ঝরে গেল তার ছোট ছেলে, ১৪ বছরের সাহিল। যে বয়সে অন্য শিশুরা স্কুলের বই, খেলাধুলা আর স্বপ্ন নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সেই বয়সে সাহিল সংসারের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিল।
সাহিলদের পরিবার আসলে ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলার বাসিন্দা। জীবিকার সন্ধানে বহু বছর আগে তারা চলে আসে দিল্লিতে। শাহদরার একটি চার ফুট বাই চার ফুট ঘরই তাদের পুরো পৃথিবী। বাবা সিরাজুদ্দিন আনসারি ছিলেন দিনমজুর। কিন্তু ছয় মাস আগে শরীরের একাংশে পক্ষাঘাত হওয়ায় তার পক্ষে আর নিয়মিত কাজ করা সম্ভব হয়নি। সংসারের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি দ্রুতই কঠিন হয়ে ওঠে। সেই সময় সাহিল নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় কাজে নামার। বয়স কম হলেও তার চোখে ছিল দায়িত্ববোধের স্পষ্ট ছাপ। বাবার ওষুধ কিনতে হবে, সংসারের খরচ চালাতে হবে—এই চিন্তাই তাকে স্কুলের বদলে কাজে পাঠায়।
বাড়ির কাছেই একটি মুদির দোকানে কাজ শুরু করেছিল সাহিল। দোকানের কাজ শেষ করে প্রতিদিন রাতের দিকে বাড়ি ফিরত সে। ২৯ নভেম্বর রাতেও তার রুটিন বদলায়নি। দোকান থেকে বেরিয়ে সে রওনা দিয়েছিল ঘরের পথে। কিন্তু সেই যাত্রাই ছিল তার জীবনের শেষ যাত্রা।
সেই রাতে শাহদরার কাছেই একটি কমিউনিটি হলে বিয়ের আয়োজন চলছিল। বরযাত্রীরা হৈ-হুল্লোড় করতে করতে এগোচ্ছিল। ভারতের অনেক জায়গার মতো এখানেও বিয়েতে টাকা ছড়ানোর রেওয়াজ রয়েছে। সাজসজ্জার জন্য বানানো নোট বা কখনো আসল নোট ছুড়ে দেওয়া হয় আনন্দ প্রকাশের অংশ হিসেবে। সেই টাকাই কুড়াতে থাকে আশেপাশে থাকা কিছু শিশু। সাহিলও তাদের একজন ছিল।
পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী, বরযাত্রীর সঙ্গে থাকা সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্সের হেড কনস্টেবল মদন গোপাল তিওয়ারি এই দৃশ্য দেখে ক্ষুব্ধ হন। নিশা আনসারির ভাষায়, তার ছেলের অপরাধ ছিল শুধু রাস্তায় পড়ে থাকা টাকা কুড়ানো। সেই টাকাও নাকি আসল ছিল না, ছিল সাজসজ্জার নকল নোট। অভিযোগ রয়েছে, প্রথমে সাহিলকে মারধর করা হয় এবং পরে খুব কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। গুলিটি সাহিলের মাথায় লাগে। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
সাহিলের ছোট ভাই সাজিম এবং তার সঙ্গে থাকা আরও দু’জন ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি এসে খবর দেয়। “পাপা, সাহিলকে গুলি করেছে”—এই কথা শুনে প্রথমে সিরাজুদ্দিন আনসারি বিশ্বাসই করতে পারেননি। ভেবেছিলেন, হয়তো বাচ্চারা মজা করছে। কিন্তু যখন তারা কাঁদতে কাঁদতে বলে যে সাহিলকে মেরে ফেলেছে, তখন বাস্তবতা তার সামনে ভেঙে পড়ে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি দ্রুত হাঁটতে পারেন না। তাই নিশাই দৌড়ে যান ঘটনাস্থলে।
কমিউনিটি হলের পাশে মাটিতে পড়ে থাকা ছেলেটিকে দেখেই নিশার সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। রক্তে ভেজা মুখ, নিথর শরীর—এই দৃশ্য তার চোখের সামনে আজও ভাসে। তিনি বলেন, ছেলেকে দেখামাত্রই তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলেন। আশেপাশে লোকজন থাকলেও কেউ তৎক্ষণাৎ সাহিলকে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি। পরে তাকে হেডগেওয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা জানান, ততক্ষণে তার মৃত্যু হয়েছে।
নিশার কাছে সাহিল ছিল শুধু উপার্জনক্ষম ছেলে নয়, ছিল পরিবারের ভরসা। তিনি বলেন, তার ছেলে কখনো মারামারি করত না, এমনকি গালিও দিতে জানত না। এতটাই শান্ত ছিল যে অনেকেই ভাবত, সে বুঝি কথা বলতে পারে না। অথচ তার ভেতরে ছিল গভীর দায়িত্ববোধ। বাবার চিকিৎসার কথা ভেবে সে প্রতিদিন কাজ করত। কীভাবে দু’পয়সা রোজগার করা যায়, সেই চিন্তাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য।
এই ঘটনার পর সাহিলের পরিবারের অভিযোগ ঘিরে শুরু হয় তীব্র বিতর্ক। একদিকে পরিবার বলছে, এটি ছিল ইচ্ছাকৃত হত্যা। অন্যদিকে অভিযুক্তের পরিবার দাবি করছে, এটি একটি দুর্ঘটনা। মদন গোপাল তিওয়ারির ভাই সোনু বলেছেন, ভিড়ের মধ্যে লোড করা পিস্তল থেকে অনিচ্ছাকৃতভাবে গুলি বেরিয়ে যায়। তার দাবি, তিওয়ারি মদ্যপ ছিলেন না এবং ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি চালাননি। তারা আইনি লড়াইয়ের কথা জানিয়েছেন।
পুলিশের বক্তব্য অবশ্য ভিন্ন ছবি তুলে ধরে। দিল্লি পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার পর অভিযুক্ত পালিয়ে যান। স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিয়ের অনুষ্ঠানের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পরদিন উত্তর প্রদেশের ইটাওয়া থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি গুলি চালানোর কথা স্বীকার করেছেন বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ জানিয়েছে, ব্যবহৃত অস্ত্রটি ছিল লাইসেন্সপ্রাপ্ত পয়েন্ট থার্টি-টু বোর পিস্তল।
সিআইএসএফ-এর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে তাদের রুলবুক অনুযায়ী, কোনো জওয়ান যদি ফৌজদারি মামলায় ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় আটক থাকেন, তাহলে তাকে সাসপেন্ড করা হয়। মামলাটি বর্তমানে আদালত ও পুলিশের তদন্তাধীন।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও সামনে এসেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র ব্যবহারের প্রশ্ন। নিশা আনসারি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সরকার কি এই জন্য অস্ত্র দেয় যে নিরীহ শিশুদের গুলি করা হবে? যদি গুলি করতেই হয়, তবে সীমান্তে গিয়ে সন্ত্রাসীদের নিশানা করা উচিত। তার চোখে সাহিল ছিল নিষ্পাপ, যার কোনো অপরাধ ছিল না।
আজ সাহিল নেই। কিন্তু তার স্মৃতি ঘিরে আছে সেই ছোট্ট ঘর, যেখানে সে একসময় বসে বাবার ওষুধের হিসাব করত। নিশা চুলার পাশে দাঁড়িয়ে রান্না করতে করতে মাঝে মাঝে থেমে যান। চোখ ভিজে আসে। তিনি বলেন, তারা গরিব মানুষ, কিন্তু শুধু ন্যায়বিচার চান। কোনো পশু নয়, কোনো পিঁপড়ে নয়—একটি মানুষকে, তাদের সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। এই ক্ষতির কোনো পূরণ নেই। তবু তারা চান, দোষী ব্যক্তির কঠোর শাস্তি হোক, যেন আর কোনো মা নিশার মতো রাতের পর রাত দরজার দিকে তাকিয়ে সন্তানের ফেরার অপেক্ষা না করে।
দিল্লির সেই গলিতে এখনো রাত নামলে নিস্তব্ধতা নামে। কিন্তু নিশা আনসারির ঘরে নিস্তব্ধতার ভেতর লুকিয়ে থাকে কান্না, ক্ষোভ আর একরাশ প্রশ্ন। সাহিলের গল্প শুধু একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়; এটি দারিদ্র্য, ক্ষমতা আর অস্ত্রের অপব্যবহারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য শিশুর গল্প। এই গল্প শেষ হয়নি। আদালতের রায়, তদন্তের ফল—সবকিছুর অপেক্ষায় আছে একটি পরিবার। কিন্তু সাহিল আর ফিরবে না। ফিরবে না সেই কড়া নাড়ার শব্দ, যে শব্দের অপেক্ষায় নিশা আজও রাত জেগে থাকেন।
আপনার মতামত জানানঃ