মধ্যযুগে মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিষ্টান বিজ্ঞানীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। ইতিহাসে এর প্রমাণও পাওয়া যায়। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের ইতিহাসের অধ্যাপক ফেদেরিকা গিগান্তে এমনই একটি প্রমাণ হাজির করেছেন। আর সেই গল্প উঠে এসেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের পাতায়।
বছর খানেক আগে, ফেদেরিকা গিগান্তে ইতালিয়ান সংগ্রাহক লুদোভিকো মসকার্দোর একটি ছবি খোঁজ করছিলেন ইন্টারনেটে। সেই সময় গিগান্তের চোখ আটকে যায় অন্য একটি ছবিতে। যেটি মূলত একটি অ্যাস্ট্রোলাব। মধ্যযুগে অ্যাস্ট্রোলাব ব্যবহার করা হতো তারকার সাহায্যে বিভিন্ন স্থানের স্থানাঙ্ক ও সময় নির্ণয়ের জন্য। জলপথে এই যন্ত্র মানুষকে দিক ও পথ চিনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করত।
তবে গিগান্তের কাছে সবচেয়ে বেশি অবাক লেগেছে সেই অ্যাস্ট্রোলাবের গায়ে খোদাই করা আরবি ও হিব্রু ভাষার লেখা। এ ধরনের একটি অ্যাস্ট্রোলাব ইতালির ভেরোনা ফন্দাজিওনে মুজিও মিনিসকালকি এরিজ্জো জাদুঘরে রাখা আছে। পরে গিগান্তে সেই জাদুঘরে গিয়ে সেই অ্যাস্ট্রোলাব পর্যবেক্ষণ করেন।
পিতলের তৈরি এই অ্যাস্ট্রোলাবটি অন্তত ১ হাজার থেকে ১১ শ বছরের পুরোনো। তবে প্রথম দিকে ভেরোনার জাদুঘরের কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, এটি হয়তো কয়েক শ বছরের পুরোনো। এ বিষয়ে গিগান্তে বলেন, ‘তাঁরা যতটা প্রাচীন ভেবেছিল, তার চেয়েও এটি অনেক বেশি পুরোনো।’
তবে প্রাচীনত্ব নয়, এই গিগান্তেকে বেশি অবাক করেছিল অ্যাস্ট্রোলাবটির গায়ে খোদাই করা আরবি ও হিব্রু ভাষার নির্দেশনা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটা পর্যায় পর্যন্ত আমি কল্পনাই করতে পারছিলাম না যে, এখানে হিব্রুতে লেখা থাকতে পারে।’
গিগান্তের ইসলামি ইতিহাসের ওপর বেশ ভালো দখল আছে। এক সময় তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইসলামিক সায়েন্টিফিক ইনস্ট্রুমেন্ট জাদুঘরের কিউরেটর ছিলেন। ফলে, তাঁর জন্য হিব্রু ভাষা কঠিন হলেও খুব একটা অজানা ছিল না। আরবি তো অচেনা নয়ই।
অ্যাস্ট্রোলাবটি পর্যবেক্ষণের পর গিগান্তে বলছেন, এটি সম্ভবত স্পেনের আন্দালুসিয়ায় তৈরি হয়েছিল এবং এরপর সেটি মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিষ্টান—বিভিন্ন ধর্মের মানুষের হাত ঘুরে লুদোভিকো মসকার্দোর কাছে এসে পড়েছিল। গিগান্তের ধারণ, দশম শতাব্দীতে তৈরি করা এই অ্যাস্ট্রোলাবটি স্পেন থেকে উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ঘুরে এক সময় ইতালিতে পৌঁছেছিল।
গিগান্তের মতে, অ্যাস্ট্রোলাবটিতে থাকা আরবি ও হিব্রু ভাষার খোদাই করা লেখা থেকে মধ্যযুগে আইবেরিয়া উপদ্বীপের মুসলিমশাসিত আন্দালুসিয়ায় মুসলমান ও ইহুদি বিজ্ঞানীদের যৌথ প্রয়াসে কীভাবে জ্ঞান সৃষ্টি হতো, কীভাবে তা ছড়িয়ে পড়ত এবং কীভাবে তা বৃদ্ধি পেত সে বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
গিগান্তে অ্যাস্ট্রোলাবটিকে আরবি ও হিব্রু ভাষায় লেখায় ও চিহ্নগুলো ভাষান্তরকরণ করেন এবং বুঝতে পারেন যে, এই গোলাকৃতির অ্যাস্ট্রোলাবের এক পাশে স্পেনের টলেডো শহরের স্থানাঙ্ক চিহ্নিত ও অপর পাশে কর্ডোবার স্থানাঙ্ক।
এই অ্যাস্ট্রোলাবটিতে যেসব তারকার অবস্থান উল্লেখ করা হয়েছে, সাধারণত ১০৬০ থেকে ১০৭০ সালের দিকে নাবিক কিংবা অভিযাত্রিকেরা এ ধরনের অ্যাস্ট্রোলাব ব্যবহার করতেন। গিগান্তের দেখা অ্যাস্ট্রোলাবটিতে উত্তর আফ্রিকার অক্ষাংশ চিহ্নিত করা আছে। গিগান্তে ধারণা করছেন, প্রথম দিকে যার কাছেই এটির মালিকানা থাকুক না কেন তিনি প্রায়ই উত্তর আফ্রিকায় ভ্রমণ করতেন।
অ্যাস্ট্রোলাবে লেখা শব্দগুলোর ভাষান্তর করার পর দেখা গেছে, সেখানে ‘আইজ্যাকের জন্য জোনাহের তৈরি’। এই দুটি নামই সে সময় ইহুদিরা ব্যবহার করত। তাই ধারণা করা যায়, এই অ্যাস্ট্রোলাবটি কোনো ইহুদিরই মালিকানায় তৈরি হয়েছিল।
ইহুদি মালিকানার হলেও মজার বিষয় হলো, এতে আরবি লেখাও ছিল। তবে সেই আরবি কোনো ইহুদিও লিখে থাকতে পারেন। কারণ, সেই সময়ে অনেক ইহুদি ও খ্রিষ্টান আরবি ভাষায় হরদম কথা বলতে পারতেন। কিন্তু গভীরভাবে অনুসন্ধানের পর জানা গেল, আরবি ও হিব্রু দুটি ভিন্ন হাতের ও ভিন্ন সময়ে লেখা। এ থেকে ধারণা করা যায়, হয়তো পরে কোনো এক সময়ে এই অ্যাস্ট্রোলাবটিকে আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
তবে গিগান্তের অনুমান, আরবি ভাষাই প্রথমে লেখা হয়েছে। পরে হাত ঘুরে সেটি উত্তর আফ্রিকার ইহুদি জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় এবং তাঁরা কিছু সংযোজন করে এতে। এরপর সেটি হাত ঘুরে আবারও ইউরোপে চলে আসে। তবে এবার ইতালিতে এবং শেষ পর্যন্ত তা মসকার্দোর হাতে পড়ে।
গিগান্তে তাঁর এই আবিষ্কারের বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণা নিবন্ধ লিখেছেন নুনসিয়াস জার্নালে। সেখানে তিনি বলেছেন, ইসলামি আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুগুলো কীভাবে ইউরোপে ঘুরে বেড়িয়েছে সে বিষয়ে গবেষণার একটি উদাহরণ হতে পারে এটি।
তিনি বলছেন, ‘এ ধরনের আবিষ্কার আগে কখনো ঘটেনি এবং সম্ভবত আর কখনো ঘটবে না। আমরা জানি যে,১১ শতকের স্পেনে, ইহুদি, মুসলমান ও খ্রিষ্টানেরা একে অপরের পাশাপাশি কাজ করেছে। বিশেষ করে, বৈজ্ঞানিক জগতে অনেক ইহুদি বিজ্ঞানীই নিজ ধর্ম নিয়ে উদ্বেগ ছাড়াই মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং এটি সেই ইতিহাসের একটি অত্যন্ত বাস্তব, জলজ্যান্ত প্রমাণ।’
আপনার মতামত জানানঃ