মানবসভ্যতার ইতিহাস মূলত রক্ত আর ধ্বংসের ইতিহাস। শান্তি নয়, যুদ্ধই যেন মানুষের প্রকৃত ধর্ম। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ সংঘাত আর প্রতিহিংসার মধ্য দিয়েই তার ইতিহাস রচনা করেছে। কাদেশ যুদ্ধকে আমরা প্রাচীনতম নথিভুক্ত যুদ্ধ বলে জানি—খ্রিষ্টপূর্ব ১২৭৪ সালের সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় হিত্তি ও মিশরীয়দের মধ্যে। তবে তার বহু আগেও কত সহস্র যুদ্ধ হয়েছিল, যার কোনো লিখিত নিদর্শন নেই—শুধু রয়ে গেছে পাথর ভাঙা অস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ আর রক্তাক্ত নিঃশব্দতা।
জাতি, ভূখণ্ড ও সভ্যতার উত্থান-পতনের মূল চালিকাশক্তি বরাবরই যুদ্ধ। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে যুদ্ধ একেকটি মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ১২০০ সালের দিকে পৃথিবীর কেউই চিনত না চেঙ্গিস খান নামের কোনো যোদ্ধাকে। কিন্তু ১২১৮ সালের পর খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য গুঁড়িয়ে দিলেন তিনি। মঙ্গোলরা ক্রমেই গড়ে তোলে ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্য, যার আওতায় একসময় বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এলাকা। এই সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে তারা হত্যা করে কোটি কোটি মানুষকে। বাগদাদের পতনের পর দিনের পর দিন ফোরাত নদীর পানি লাল হয়ে ছিল মানুষের রক্তে।
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে এসেছে গ্রিক, পারস্য, রোমান, আরব ও মোঘল সাম্রাজ্যের উত্থান। প্রতিটিই যুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে এবং যুদ্ধেই ভেঙে পড়েছে। এরপর আসে বিংশ শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধ—যা শুধু ভূখণ্ডের মানচিত্র বদলায়নি, বদলে দিয়েছে মানব সভ্যতার আত্মপরিচয়। সেই যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেই আইনস্টাইন বলেছিলেন, “আমি জানি না তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিসে হবে, কিন্তু চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে পাথর আর তির–ধনুক দিয়ে।” ওপেনহাইমার বলেছিলেন, “Now I am become Death, the destroyer of worlds.” আজ আমরা সেই পথেই হাঁটছি, যেখানে ধ্বংস ছাড়া কিছু নেই।
তবে আজকের যুদ্ধ আগেকার মতো সম্মুখসমর নয়। এখন আর সৈন্যদল নদী পেরিয়ে শত্রুর দুর্গ ঘেরাও করে না। যুদ্ধের ধরনই পাল্টে গেছে। এখন আর তরবারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়া নয়, বরং দূর থেকে বোতাম চেপে যুদ্ধ শুরু হয়। এক দেশের যুদ্ধবিমান হাজার কিলোমিটার দূরের শত্রুপক্ষের ঘাঁটিতে বোমা ফেলে। আরেক দেশ তাদের রাজধানীতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে প্রতিশোধ নেয়। রাডার, স্যাটেলাইট, ড্রোন—এই সব আধুনিক প্রযুক্তিই এখন যুদ্ধের মুখ্য হাতিয়ার।
নৌযুদ্ধেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। সমুদ্রজয়ের প্রতীক এখন আর বিশাল পালতোলা জাহাজ নয়, বরং পরমাণু সাবমেরিন—যা মাসের পর মাস পানির নিচে থেকে শত্রুর শহর ধ্বংস করে দিতে পারে। আকাশে ‘টপ গান’ সিনেমার মতো বিমানের কামান যুদ্ধ এখন আর নেই। এখন শত শত কিলোমিটার দূর থেকে শত্রুর বিমান ধ্বংস করা যায়। রাডার ফাঁকি দেওয়া স্টিলথ প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান যেন মহাভারতের অর্জুন, দূর থেকে শত্রুকে আঘাত হানে, অথচ নিজে অদৃশ্য থাকে।
ড্রোন প্রযুক্তি যুদ্ধকে দিয়েছে এক ভয়ঙ্কর রূপ। মানুষবিহীন এই যন্ত্রগুলোর মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে মানুষ হত্যা এখন খুবই সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ, ইরানে পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যা কিংবা হামাসের নেতাদের মৃত্যু—সবই ড্রোন আর রিমোট কন্ট্রোল প্রযুক্তির উদাহরণ। যুদ্ধ এখন এমন এক বিন্দুতে এসেছে, যেখানে নৈতিকতা, মানবতা, এমনকি উপস্থিতি—সবই অপ্রয়োজনীয়। শুধু লক্ষ্য নির্ধারণ করলেই যথেষ্ট, বাকি কাজ করবে মেশিন।
আর এসব যুদ্ধের পিছনে যুক্তিগুলো? সেগুলো যেন প্রহসন। যুদ্ধের জন্য এখন আর প্রকৃত কোনো কারণ লাগে না। শুধু একটি অজুহাতই যথেষ্ট। “তোমার বাবা পানি ঘোলা করেছিলেন”—এই যুক্তিতেই যুদ্ধ শুরু হয়। ইরাক যুদ্ধের সময় গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অজুহাত ছিল, যা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ইসরায়েলের হাতে রয়েছে প্রায় ১০০ পারমাণবিক অস্ত্র, সবাই জানে, কিন্তু কেউ স্বীকার করে না। অন্যদিকে ইরান যেন একটি বোমাও তৈরি না করে—এই দ্বিচারিতা যে কেবল রাজনৈতিক নয়, তা সভ্যতার এক নির্মম ব্যর্থতাও।
জনাথন সুইফট তাঁর ব্যঙ্গরচনায় বলেছিলেন, দুই জাতি শত বছর যুদ্ধ করছে এই নিয়ে যে ডিম মোটা দিক দিয়ে ভাঙা উচিত, নাকি সরু দিক দিয়ে। বর্তমান বিশ্বের যুদ্ধগুলো তার চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয়। ধর্ম, ভৌগোলিক দাবি, জাতীয় গর্ব—এই সব কিছুই যেন আজ যুদ্ধের ‘যুক্তিকথা’। অথচ ভিতরে লুকিয়ে থাকে অস্ত্র ব্যবসা, ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং পুঁজিবাদের লোভ।
গাজার রক্তাক্ত বেদনা, সিরিয়ার ভস্মীভূত নগরী, ইয়েমেনের ক্ষুধার্ত শিশুরা, সুদানের নীরব গণহত্যা—সবই প্রমাণ করে, আমরা এখনো সভ্য হইনি। পশ্চিমা দেশগুলো শান্তির কথা বলে, মানবাধিকার রক্ষা করার কথা বলে, অথচ নিজেরাই অস্ত্র সরবরাহ করে, আর চোখ বুজে থাকে মিত্রদের নৃশংসতায়। মানবতা কোথায়? নৈতিকতা কোথায়? প্রশ্নগুলো কেবল ধাক্কা দেয় বিবেককে, কিন্তু উত্তর মেলে না।
চীনের প্রযুক্তিগত উত্থান গোটা বিশ্বকে নতুন এক যুদ্ধ বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছে। ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অস্ত্রব্যবস্থা, লেজার প্রযুক্তি—সবই এখন বাস্তব। পাকিস্তান চীনের সহায়তায় ভারতের রাফাল বিমান ভূপাতিত করেছে বলেও তথ্য রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের আধিপত্য হারাতে চাইছে না, তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা প্রযুক্তির, কূটনীতির এবং সামরিক বলয়ের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। কিন্তু তাদেরই বানানো নিয়ম আজ তাদেরই পেছনে ছুরি বসাচ্ছে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি শুরু হয়ে গেছে? অনেকেই মনে করেন, হ্যাঁ। শুধু যুদ্ধের ধরন পাল্টেছে। এটি এখন অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সাইবার এবং কূটনৈতিক যুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সংঘাত—সবই বিশ্বযুদ্ধের অঙ্গ হয়ে উঠছে। বাকি শুধু সরাসরি ঘোষণার অপেক্ষা।
মানুষ কখনোই স্থায়ী শান্তিতে বিশ্বাস করেনি। এই শতাব্দীতেও করছে না। বরং যুদ্ধকে চিরন্তন বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করেছে। কারণ, যুদ্ধই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা, সবচেয়ে কার্যকর নিয়ন্ত্রণের উপায়, আর সবচেয়ে সহজ পথ ক্ষমতা ধরে রাখার। যুদ্ধ এখন আর শুধু অস্ত্রের খেলা নয়, এটি প্রযুক্তির, রাজনীতির, অর্থনীতির, এমনকি মিডিয়ারও খেলা।
তাই হয়তো, মানবসভ্যতা আজ ভয়াবহ এক বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে। যেকোনো মুহূর্তেই ঘটতে পারে আণবিক যুদ্ধ। আর তা হলে, সত্যিই আমাদের উত্তরসূরিরা পাথর আর তির–ধনুক নিয়ে লড়বে, কারণ সভ্যতা তখন আর থাকবে না। রবার্ট ওপেনহাইমারের সেই বিখ্যাত উক্তি—“Now I am become Death, the destroyer of worlds”—আজ যেন শুধু একটি শ্লোক নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যতের ছায়াছবি।
আপনার মতামত জানানঃ