নদীবাঁধ আর চৌম্বক মেরু পরিবর্তনের মতো বিষয় সাধারণভাবে একসঙ্গে ভাবা যায় না। কিন্তু সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই বিস্ময়কর তথ্য—বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার নদীতে বাঁধ দিয়ে জল সংরক্ষণের ফলে বদলে যেতে শুরু করেছে পৃথিবীর চৌম্বক মেরুর অবস্থান। পরিবেশ নিয়ে বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের নানা উদ্বেগের পাশে এটি যেন নতুন এক অশনিসঙ্কেত।
পৃথিবীর চৌম্বক মেরু স্থায়ী নয়, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে স্থান বদলায়—এই বিষয়টি বিজ্ঞানের অজানা নয়। চৌম্বক ক্ষেত্র মূলত পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা তরল লোহার কোরের গতিশীলতার ফলে তৈরি হয় এবং এই কোরের চলাচলের কারণেই চৌম্বক মেরু পরিবর্তিত হয়। তবে এত দিন এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনকেই দায়ী করা হতো। এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষেরই তৈরি বাঁধ এবং জল সংরক্ষণের ফলে পৃথিবীপৃষ্ঠে ভরের যে পুনর্বণ্টন হচ্ছে, সেটিও চৌম্বক মেরুর গতিবিধিকে প্রভাবিত করছে।
হার্ভার্ডের ভূ-পদার্থবিজ্ঞানী নাতাশা ভ্যালেন্সিক এবং তাঁর দলের গবেষণায় উঠে এসেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ৭০০০টি বাঁধে যে বিপুল পরিমাণ জল আটকে রাখা হয়েছে, সেই ঘনীভূত ভরের প্রভাবে পৃথিবীর ভূত্বকের ঘূর্ণন অক্ষ প্রায় এক মিটার সরে গিয়েছে। এ রকম ঘূর্ণায়মান একটি গোলকের (এক্ষেত্রে পৃথিবী) গায়ে অতিরিক্ত ওজন চাপলে ভারী অংশ বিষুব অঞ্চলের দিকে সরে যায় এবং এর ফলে বদলে যেতে পারে সেই গোলকের ঘূর্ণন অক্ষ। এই বদলই চৌম্বক মেরুর অবস্থানে পরিবর্তন এনে দেয়।
এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৮৩৫ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বাঁধ নির্মাণের ফলে চৌম্বকীয় উত্তর মেরু প্রায় ২০ সেন্টিমিটার রাশিয়ার দিকে সরে গিয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে, ১৯৫৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এশিয়া এবং পূর্ব আফ্রিকায় বাঁধ নির্মাণের জেরে এটি আবার প্রায় ৫৭ সেন্টিমিটার পশ্চিমে, উত্তর আমেরিকার দিকে সরে এসেছে।
একে বলা হয় ‘প্রকৃত মেরু বিচরণ’ বা True Polar Wander, যেখানে মেরু নিজের জায়গায় স্থির থাকলেও পৃথিবীপৃষ্ঠের ভরবন্টন পরিবর্তনের কারণে তার উপরের অঞ্চল সরতে থাকে, আর তার ফলে মনে হয় যেন মেরুই স্থান পরিবর্তন করছে। বাস্তবিক অর্থে এটি পৃথিবীর উপরিস্তরের (ক্রাস্ট) সরে যাওয়া, ভিতরের কোর নয়।
এই জলাধারগুলো কেবল চৌম্বক ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলছে না, বদলে দিচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও। হিসাব বলছে, এত বড় মাপের জল সংরক্ষণের ফলে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক ধাক্কায় কমেছে প্রায় ২১ মিলিমিটার। প্রতিবছর এই হ্রাসের হার দাঁড়ায় ১.২ মিলিমিটার। যদিও এটাকে কিছুটা ইতিবাচক দিকও বলা যায়, কারণ মানব-সৃষ্ট উষ্ণায়নের ফলে যেভাবে বরফ গলছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ ক্রমে বাড়ছে, তার বিপরীতে বাঁধের কারণে কিছুটা হলেও ভারসাম্য আসছে।
তবে এই পরিবর্তনের ফল কিন্তু ভয়াবহ হতে পারে। উত্তর চৌম্বকীয় মেরুর ঘন ঘন স্থানবদলের ফলে বিপর্যস্ত হতে পারে নৌ ও বিমান চলাচল। দিগ্ভ্রান্ত হবে সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজ, আকাশে উড়ন্ত বিমানের নেভিগেশন ভুল করবে। স্মার্টফোনে দেখা গুগল ম্যাপও বিপথে চালাতে পারে। আরও গভীর স্তরে, এর প্রভাব পড়তে পারে বায়ুমণ্ডলের গঠন, সমুদ্রস্রোত, এমনকি আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপেও।
তাই এই গবেষণা আমাদের সামনে যে বিষয়টি তুলে ধরে, তা হলো—আমরা যখন প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাই, তখন প্রকৃতিও পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায়। বাঁধের মাধ্যমে নদীকে আটকে রাখা কিংবা ভূগর্ভস্থ জল তোলার মতো কাজ শুধুমাত্র স্থানীয় পরিবেশ বা কৃষির উপর নয়, বরং পৃথিবীর চৌম্বক বলয়ের মতো অদৃশ্য কিন্তু গভীর স্তরেও প্রভাব ফেলতে পারে। আর সেই পরিবর্তন আমাদের প্রতিদিনের জীবনে নেভিগেশন থেকে শুরু করে প্রযুক্তিগত পরিকাঠামোর উপর ফেলতে পারে অপ্রত্যাশিত ছাপ।
এই বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রযুক্তির অগ্রগতি যতই হোক, প্রকৃতির সূক্ষ্ম ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে তার ফল ভোগ করতে হয় সমগ্র মানবসভ্যতাকে। নদী, জলাধার, পাহাড় কিংবা মেরু—সব কিছুর মধ্যে রয়েছে এক গভীর আন্তঃসম্পর্ক, যার গুরুত্ব আজ আবার নতুন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন বিজ্ঞানীরা।
আপনার মতামত জানানঃ