বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার একটি ছোট গ্রাম বাগুনি—স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘এক কিডনির গ্রাম’ নামে। কারণ এখানকার অনেক বাসিন্দাই দারিদ্র্য ঘোচাতে নিজেদের কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে ৪৫ বছর বয়সী সাফিরউদ্দিন তার কিডনি বিক্রি করেন ভারতের এক রোগীর কাছে। দাম পান ৩৫০,০০০ টাকা (প্রায় ২৮৫০ ডলার)। স্বপ্ন ছিল একটি বাড়ি বানাবেন সন্তানদের জন্য। কিন্তু বাড়ি এখনও অসমাপ্ত, টাকা শেষ, আর শরীরের যন্ত্রণা এখন নিত্যসঙ্গী।
তিনি এখন কাজ করেন একটি ঠান্ডা ঘরের শ্রমিক হিসেবে। কাজ করতে গিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, কারণ অস্ত্রোপচারের পর তার স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে।
“আমি সব করেছি পরিবারকে ভালো রাখতে। স্ত্রী-সন্তানদের জন্যই নিজের শরীর বিক্রি করেছিলাম,” বলেন সাফিরউদ্দিন।
তাকে ভারতের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয় মেডিকেল ভিসায়। সব ব্যবস্থা ছিল দালালদের। পাসপোর্ট, নথিপত্র, হাসপাতালের কাগজপত্র—সব তারা করেছে। এমনকি জাল পরিচয়পত্র তৈরি করে দেখানো হয়, তিনি কিডনি গ্রহণকারীর নিকটাত্মীয়। অথচ তিনি জানেন না, তার কিডনি কে পেয়েছে।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন বিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্য ড. মনির মনিরুজ্জামান বলেন, “সাধারণভাবে দাতার নাম বদলে যায়, আইনজীবীর সিলমারা জাল শংসাপত্র দিয়ে প্রমাণ দেখানো হয়—তারা নিকটাত্মীয়, যাতে করুণা বা ভালোবাসার ছলেই অঙ্গদান দেখানো যায়।”
২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, কালাই অঞ্চলে প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন কিডনি বিক্রি করেছেন।
৪৫ বছর বয়সী যোসনা বেগম, কালাইয়ের বিনাই গ্রামের বাসিন্দা। স্বামী মারা যাওয়ার পর জীবিকা নির্বাহ করতে ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। সেখানেই এক দালালের মাধ্যমে ভারতের এক হাসপাতালে গিয়ে কিডনি বিক্রি করেন। প্রতিশ্রুতি ছিল ৭ লাখ টাকা, কিন্তু পেয়েছেন মাত্র ৩ লাখ। অপারেশনের পর তাকে ও তার স্বামীকে দেশে ফিরিয়ে আনে দালালরা। তাদের পাসপোর্টও ফেরত দেওয়া হয়নি।
“আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে,” বলেন যোসনা, যার স্বামী এরপর তাকে ছেড়ে অন্য এক নারীকে বিয়ে করে।
অনেক সময় ভিকটিমরাই পরে হয়ে ওঠে দালাল। যেমন ঢাকার এক ব্যবসায়ী সজল (ছদ্মনাম)। তিনি ২০২২ সালে কিডনি বিক্রি করে প্রতারিত হন। পরে বাধ্য হয়ে নিজেই অন্যদের কিডনি বিক্রির ফাঁদে ফেলেন। কিন্তু টাকার ভাগাভাগি নিয়ে তার ওপর চক্রের রোষ পড়ে, এবং সে এখন ‘চক্রের বন্দুকের সামনে’ বলে মনে করে।
বাংলাদেশ পুলিশ বলছে, তারা এ পাচারচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছে। একাধিক দালাল গ্রেপ্তারও হয়েছে। ভারতেও কিছু চিকিৎসক গ্রেপ্তার হয়েছেন, যেমন দিল্লির এক কিডনি সার্জন যিনি ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৫টি ট্রান্সপ্লান্ট করেন বাংলাদেশিদের নিয়ে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের কিছু বিচ্ছিন্ন গ্রেপ্তার দিয়ে চক্র ধ্বংস সম্ভব নয়। ভারতে চিকিৎসা পর্যটন একটি বৃহৎ শিল্প, যার মূল্য ২০২৪ সালে ছিল ৭.৬ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থনীতির চাপে পড়ে অনেক হাসপাতাল হয়ত নকল কাগজ দেখেও চোখ বুজে রাখে।
মনিরুজ্জামান বলেন, “অবৈধ হলেও কাগজে সবকিছু বৈধ দেখিয়ে ট্রান্সপ্লান্ট করানো হয়। এতে হাসপাতালের লাভ হয়, দালালের লাভ হয়, কিন্তু দাতা পড়ে থাকে যন্ত্রণার সাগরে।”
দালাল মিজানুর রহমান বলেন, “প্রতি কিডনিতে রোগী খরচ করে ২২,০০০ থেকে ২৬,০০০ ডলার, কিন্তু দাতাকে দেয় ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা। বাকি টাকায় চলে দালাল, চিকিৎসক, ভুয়া কাগজ প্রস্তুতকারীদের পেমেন্ট।”
কিছু ক্ষেত্রে লোকজনকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং সেখানে জোরপূর্বক কিডনি বের করে নেওয়া হয়।
ভারতের ‘কিডনি ওয়ারিয়রস ফাউন্ডেশন’ এর প্রধান বাসুন্ধরা রঘুবংশ বলেন, “যদি অঙ্গ পাচার পুরোপুরি রোধ করা না যায়, তাহলে অন্তত এটি নিয়মিতভাবে নিয়ন্ত্রিত করা উচিত। দাতাদের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা, অপারেশনের পর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা সহায়তা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত।”
কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাগুনি বা কালাইয়ের মতো গ্রামে এখনও কিডনি বিক্রি চলছেই। সাফিরউদ্দিন এখনো বাড়ির কাজ শেষ করতে পারেননি। তার সন্তানরা একটি ভালো ভবিষ্যৎ পায়নি, বরং পেয়েছে একজন অসুস্থ বাবা আর একরাশ হতাশা।
“তারা আমার কিডনি নিয়েছে, আর তারপর উধাও হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।
চক্র চলে যাচ্ছে, কিডনি যাচ্ছে—শুধু স্বপ্ন আর শরীরটুকু পড়ে থাকছে দেশের দরিদ্র মানুষের।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদে শুভ্র সরকার।
আপনার মতামত জানানঃ