প্রায় ২৯ বছর আগে, ১৯৯৬ সালের ৫ জুলাই, বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে। স্কটল্যান্ডের এডিনবরার রসলিন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো একটি প্রাপ্তবয়স্ক ভেড়ার দেহকোষ থেকে ক্লোন করে একটি ভেড়ার জন্ম দেন। তার নাম ছিল ডলি। এটি ছিল প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণী, যাকে প্রাপ্তবয়স্ক কোষ থেকে ক্লোন করা হয়েছিল। এই আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক জগতে যেমন আলোড়ন তোলে, তেমনি নৈতিক বিতর্কও সৃষ্টি করে।
ডলির জন্ম হয় ‘সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার’ নামের একটি পদ্ধতিতে। বিজ্ঞানীরা একটি ফিন ডরসেট প্রজাতির ভেড়ার স্তনগ্রন্থির কোষ ব্যবহার করেন, যাতে পুরো জিনগত তথ্য থাকে। অন্যদিকে, একটি স্কটিশ ব্ল্যাকফেস ভেড়ার ডিম্বাণু থেকে নিউক্লিয়াস বের করে দেওয়া হয়। এরপর ঐ স্তনগ্রন্থির কোষ ওই ডিম্বাণুতে স্থাপন করে তাকে হালকা ইলেকট্রিক শকে উদ্দীপিত করা হয়, যাতে এটি ভ্রূণে পরিণত হয়। এই ভ্রূণটি আবার আরেকটি ভেড়ার গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। সবমিলিয়ে ১৪৮ দিন পর জন্ম নেয় ডলি।
এই গবেষণার ফলে বিজ্ঞান প্রমাণ করে যে, প্রাপ্তবয়স্ক কোষ থেকেও একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণী তৈরি সম্ভব। এটি স্টেম সেল, অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী সংরক্ষণের মতো গবেষণায় নতুন আশা জাগায়। তবে এর সঙ্গে মানব ক্লোনিং নিয়ে বড় ধরনের বিতর্কও শুরু হয়।
ডলি ছয়টি মেষশাবকের জন্ম দিয়েছিল, কিন্তু সাধারণ ভেড়ার তুলনায় কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল তার, যেমন আর্থ্রাইটিস। মাত্র ছয় বছর বয়সে, ২০০৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, ফুসফুসের অসুখে তাকে শান্তিপূর্ণভাবে মেরে ফেলা হয় (ইউথেনাইজড)। যদিও এর মৃত্যুর পেছনে ক্লোন হওয়ার কোনো সরাসরি প্রমাণ নেই, তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়।
মানব ক্লোনিং নিয়ে আজও গভীর উদ্বেগ ও বিতর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন, এটি মানব মর্যাদার অবমাননা। কারণ, মানুষ যদি শুধু নির্দিষ্ট গুণাবলি দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে সে যেন একটি যন্ত্র বা পণ্য হয়ে যায়। ক্লোনড মানুষের ব্যক্তিত্ব, পরিচয়, এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকে মনে করেন, এটি সৃষ্টিকর্তার জায়গায় মানুষের হস্তক্ষেপ, যা অনৈতিক।
তাছাড়া, ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে ‘ডিজাইনার বেবি’ তৈরি করা, শুধু ধনী মানুষদের সুবিধা পাওয়া, কিংবা সৈনিক হিসেবে ব্যবহার করার মতো ভয়ঙ্কর আশঙ্কাও রয়েছে।
এছাড়া, ক্লোন করা মানুষ গবেষণা বা অঙ্গ সংগ্রহের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
এই প্রযুক্তি পারিবারিক সম্পর্ক ও সামাজিক কাঠামোও জটিল করে তুলতে পারে। একজন ক্লোনড মানুষ হবে তার মূল ব্যক্তির সন্তান, না ভাইবোন, না কি কপি? এসব প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই।
সবচেয়ে বড় কথা, প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে যে জেনেটিক বৈচিত্র্য টিকে থাকে, ক্লোনিং সেটি ধ্বংস করতে পারে। এতে ভবিষ্যতে মানবজাতি পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারবে না।
এ সব কারণেই বেশিরভাগ দেশ মানব ক্লোনিংকে নিষিদ্ধ করেছে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, কারণ এর অনেক উপকারও হতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ