ঢাকার রাজনীতির ভাঁজে ভাঁজে যে দুর্বৃত্তায়নের চোরাস্রোত দীর্ঘদিন ধরেই বইছে, আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদের কাহিনি যেন তার এক নগ্ন প্রতিচ্ছবি। রিয়াদের গল্প শুরু হয়েছিল এক সাধারণ দিনমজুর পরিবারের সন্তান হিসেবে, কিন্তু তার উত্থান হয় ঢাকার অন্যতম ধনকুবের চাঁদাবাজ হিসেবে—যার ‘কোটির নিচে কথা নেই’। এই অভাবী ছাত্রের রাতারাতি কোটিপতি হয়ে ওঠার রহস্য কেবল একটি ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারি নয়, বরং সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরে লুকিয়ে থাকা রাজনৈতিক আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা এক ‘ছায়া শক্তির’ নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ।
রিয়াদ, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির ছাত্র, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে যে রাজনৈতিক জাল বিস্তার করেছিল, সেটি একদিকে যেমন আদর্শের মোড়কে মোড়ানো ছিল, অন্যদিকে ছিল ভয়ভীতি ও অর্থ-ক্ষমতার নগ্ন প্রদর্শন। এই সংগঠনের নামে সে শুধু চাঁদাবাজিই করেনি, বরং চাকরি-বদলি, জমি দখল, এমনকি জমি ‘উদ্ধার’ নামে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও পালন করত। একজন ছাত্র কীভাবে রাজনীতির ছায়ায় এতটা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারে, তার জবাব খুঁজতে গেলে আমরা বারবার ফিরে আসি রাষ্ট্রীয় ছত্রচ্ছায়া আর নীরব সমর্থনের দিকে।
গল্পের সবচেয়ে অশ্লীল দিকটি হলো—তার এতোসব অপকর্ম সবার জানা সত্ত্বেও কেউ মুখ খোলেনি, আইন প্রয়োগ হয়নি, বরং বিভিন্ন ‘উচ্চপর্যায়’ থেকে তার পক্ষে তদবির করা হতো। পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, তার লুটপাটের সময়ও অনেকে কেবল দাঁড়িয়ে দেখেছে, কেউ বাঁধা দেয়নি—কারণ সেই ‘মব’-এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক গডফাদারদের ছায়া। শুধু তাই নয়, চাঁদার একটি বড় অংশ নাকি উপরের দিকেও যেতো—এই ‘উপর’টা কারা, সেখানেই উঠছে গুরুতর প্রশ্ন।
রিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু রাজনৈতিক হুমকি-ধামকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। গুলশানের সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদের বাড়িতে গিয়ে সে চাঁদার দাবিতে ‘প্রেসার গ্রুপ’ হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১০-১২ জনের একটি দল নিয়ে তারা বাসায় হামলার ভয় দেখিয়ে ১০ লাখ টাকা আদায় করে এবং আবার ফিরে আসে আরও ৫০ লাখ টাকা তুলতে। এবার যদিও পুলিশ হাতে নাতে ধরে ফেলে তাকে, কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে।
রিয়াদের বাসায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ যা পেয়েছে, তা চাঁদাবাজির এই দুর্নীতির মাত্রা বোঝাতে যথেষ্ট। শুধু একটি চেকের পরিমাণই ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। পাশাপাশি পাওয়া গেছে আরও ২০ লাখ টাকার এফডিআরের স্লিপ, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬০-৭০ লাখ টাকার লেনদেনের প্রমাণ, এবং আরও অনেক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লুকানো লেনদেনের ইতিহাস। সেই ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার চেকটি যে রংপুর-৬ এর সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদের সই করা, সেটিও এই দুর্নীতির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
আসলে এই চাঁদাবাজি কেবল রিয়াদ নামের এক দুর্বৃত্তের নয়—এটা একটা সমগ্র নেটওয়ার্ক, যার শিকড় বিস্তৃত হয়েছে ছাত্র রাজনীতি, পেশাজীবী মহল, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অংশের মধ্যেও। “প্রেসার গ্রুপ”—এই মধুর নামধারী একটি মবকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার মানে হল রাষ্ট্র নিজেই তাদের হালকা করে দেখেছে। যখন চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে, তখনও কেউ অভিযোগ করেনি—কারণ ভয় ছিল, অভিযোগ করলেই বিপদ বাড়বে। তার মানে দাঁড়ায়, ভুক্তভোগীরা শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং তারা রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা হারিয়েছে।
এখানেই প্রশ্ন জাগে—এই ধরনের অপরাধের নেপথ্যে কারা? কারা এই দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দেয়? তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, রিয়াদদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেই ‘উপর মহল’ থেকে ফোন আসতো, অনুরোধ আসতো, হুমকি আসতো। যেসব মানুষ এই চাঁদার টাকা দিতো, তারাও কেউ মুখ খুলতো না, বরং নিজেদের রক্ষা করতেই চুপ থাকতো। অথচ এসব অর্থহীন ভয়ের মধ্য দিয়েই একটি পুরো সমাজব্যবস্থা জিম্মি হয়ে পড়ে কিছু দুর্বৃত্তের হাতে।
এই ঘটনার সবচেয়ে দুঃখজনক দিকটি হলো—রিয়াদ এবং তার সহযোগীরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর সংগঠন থেকে তাদের ‘বহিষ্কার’ করা হয়েছে। যেন আগের সব অপরাধ সংগঠন চোখ বন্ধ করে মেনে নিয়েছিল। এখন যখন ঘটনা জনসম্মুখে এসেছে, তখন দায় এড়াতে ‘বহিষ্কার’! এই প্রবণতা আমাদের পরিচিত—যতক্ষণ না ধরা পড়ে, ততক্ষণ ছায়া দেওয়া, আর ধরা পড়লেই ‘আমরা দায়ী না’ বলে সরে যাওয়া।
এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে—রিয়াদের মতো আরও কতজন ‘চাঁদাবাজ ছাত্র নেতা’ আছে এই দেশে, যার মাথার উপর রাজনীতির ছাতা আছে? তাহলে নিশ্চয়ই উত্তর হবে—অনেক। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই মন্তব্য করছেন, “লক্ষ লক্ষ রিয়াদ আমাদের চারপাশে”—এটা কেবল হতাশা নয়, এটা হুঁশিয়ারি।
তবে এই হুঁশিয়ারি কতটা কার্যকর, সেটা নির্ভর করবে রাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর। যদি সত্যিই আমরা দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই, তাহলে কেবল রিয়াদকে গ্রেপ্তার করলেই চলবে না—তার ‘গুরুদের’, তার ‘পৃষ্ঠপোষকদের’, তার ‘চাঁদার ভাগ নেওয়াদের’ও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
নাহলে, ভবিষ্যতের রিয়াদরা আবার জন্ম নেবে—আরো শাণিত, আরো সংগঠিত, আরো ভয়ংকরভাবে।
আপনার মতামত জানানঃ