অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে ন্যায়বিচার ও সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি জনগণের মধ্যে আশা জাগিয়েছিল, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই আশায় ভর করতে শুরু করেছে গভীর হতাশা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সরকারঘনিষ্ঠ ছাত্র সংগঠনগুলোর দুর্নীতি, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এবং অতীতের এক-এগারোর ছায়া বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এই সরকার সত্যিই সংস্কারের পথে হাঁটছে, না কি পুরনো চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে—সেই প্রশ্ন এখন আরও জোরালো।
সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘদিন প্র্যাকটিস করা একাধিক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জানিয়েছেন, বর্তমানে বিচারকরা স্বাধীনভাবে আদেশ দিতে পারছেন না। ভয় ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন তারা। আদালতে জামিন কিংবা দণ্ডে রাজনৈতিক প্রভাব, বিচারাধীন বিষয় নিয়ে বিতর্ক এবং আদালতের চত্বরে আইনজীবী ও আসামিদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো বিচার ব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। একসময় নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক মামলার ক্ষেত্রেই এই ভয় ছিল, এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে সবক্ষেত্রে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন সম্প্রতি এক গোলটেবিল আলোচনায় বলেন, “বাংলাদেশে এখন কেউই বলতে পারবে না, সে ভয়ভীতির বাইরে আছে। বিচারব্যবস্থার ভেতরেও, বাইরেও ভয় আছে।” বিচারকেরা নিজের আদেশের ভবিষ্যত প্রতিক্রিয়া নিয়ে শঙ্কায় থাকেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিচার বিভাগের এই সংকটের মধ্যেই বিতর্কিত হয়ে উঠেছে কিছু ছাত্র সংগঠন ও তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা। ‘জুলাই আন্দোলন’ থেকে রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং তাদের ঘনিষ্ঠ দুই ছাত্র সংগঠন—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, নারী কেলেঙ্কারি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও তদবিরের অভিযোগ উঠেছে। কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার ও বহিষ্কার করা হলেও, চাঁদাবাজি ও লবিংয়ের প্রবণতা থামেনি।
সম্প্রতি এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীর পাঠ্যবই ছাপা ও জেলা প্রশাসক নিয়োগে প্রভাব খাটানোর অভিযোগে অব্যাহতি পেয়েছেন। অন্যদিকে, দলটির আরেক নেতা সারজিস আলমের সরকারি দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করাও ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় এনসিপি নেতাদের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি, পুলিশের পরিচয়ে হয়রানি এবং প্রতিপক্ষের ওপর মব হামলার অভিযোগ উঠেছে। কোথাও গণপিটুনি, কোথাও মামলা—সব মিলিয়ে জনমনে আন্দোলনের শুরুর সেই আস্থা আজ নড়বড়ে।
এনসিপির কার্যক্রম নিয়ে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে তাদের বহু কর্মসূচিতে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সরাসরি সহায়তা। এ বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, “সরকার একটি দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ স্পষ্ট করছে।” তার মতে, অতীতের মতোই সরকার আবার নতুন এক ‘কিংস পার্টি’ তৈরির পথে রয়েছে, যার ফল ভোগ করবে গোটা দেশ।
এনসিপির শীর্ষ নেতাদের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, আদর্শহীনতা ও দুর্নীতির প্রবণতা দলটির ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। শুধু এনসিপিই নয়, বিতর্কে জড়িয়েছেন সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এবং জুলাই আন্দোলনের অন্যতম মুখ আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তার বিরুদ্ধে মুরাদনগরে প্রভাব বিস্তার, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি এবং আত্মীয়কে নেতৃত্বে বসানোর অভিযোগ উঠেছে। তার বাবা বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধেও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসনের অভিযোগ রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “দিন যত যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে হতাশা বাড়ছে। সংস্কার ও নির্বাচন—দুই নিয়েই সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে।” বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “সরকার দৃশ্যমানভাবে কাজ করছে—এমন কেউ বলছে না। দুর্নীতি চলছে আগের মতোই। বরং কোনো ক্ষেত্রে তা আরও বেশি।” নির্বাচন বিলম্বিত হলে দেশের রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর এই সরকারকে ‘মেরুদণ্ডহীন ও সবচেয়ে দুর্বল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সরকারের কর্মকাণ্ডের বাস্তবতা আজ সম্পূর্ণ বিপরীত।
এই অবস্থায় অনেকেই তুলনা টানছেন ২০০৭ সালের এক-এগারো সময়ের সঙ্গে। তখন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক অনাস্থার মধ্যে ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং দুই শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নতুন নেতৃত্ব গঠনের চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত গণআন্দোলনের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হলেও, সেই সময়ের কোনো কুশীলব আজও বিচারের মুখোমুখি হয়নি।
বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডে সেই সময়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। বিরোধী কণ্ঠ রোধ, গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা, সংস্কারের নামে নিয়ন্ত্রণ—সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠছে, বর্তমান সরকার কি এক-এগারোর পথেই হাঁটছে? যদি তাই হয়, তবে অতীতের দায়মুক্তির ইতিহাস আবারও পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে, যার খেসারত দিতে হবে গোটা জাতিকে।
আপনার মতামত জানানঃ