বাষ্প ইঞ্জিনের আবিষ্কারে শুরু হয়েছিল প্রথম শিল্পবিপ্লব, বিদ্যুতের উদ্ভাবনে হয়েছিল দ্বিতীয়টি আর কম্পিউটার-ইন্টারনেটের প্রচলনে চলছিল তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। আর এখন অটোমেশন দিয়ে শুরু হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। কোভিড-১৯-এর ধাক্কায় এমনিতেই অনেকের চাকরি গেছে। এর মধ্যে আরেক দুঃসংবাদ হলো, এ সংকটে অটোমেশন প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। অটোমেশন বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থানে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে। এর প্রভাবে বাংলাদেশে প্রায় ৫৩ লাখ চাকরিজীবীকে তাদের চাকরি হারাতে হবে। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও দক্ষতা এই ধাক্কা সামলাতে পারবে না। এমনটা জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কি
১৭৮৪ সালে শুরু হয় প্রথম শিল্পবিপ্লব বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের উপর ভর করে। বাষ্পীয় ইঞ্জিন মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিল গতিকে। যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু আধুনিক শিল্পায়নের দিকে। বাড়ে কয়লার খনি ও ইস্পাতের ব্যবহার। বিদ্যুতের উদ্ভাবনে ফলে ১৮৭০ সাল থেকে শুরু হয় দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। উৎপাদনে নতুন অধ্যায় শুরু। বৈদ্যুতিক বাতি মানুষকে দেয় এক নতুন আলোকিত বিশ্ব। উদ্ভব ঘটে প্রোডাকশন লাইন ধারণার। উৎপাদন বাড়ে বহুগুণ। ১৯৬৯ সাল কম্পিউটা আসার পর থেকে শুরু হয় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। কম্পিউটারের ব্যবহার ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির শুরু। আবিষ্কৃত ইন্টারনেট জগৎকে এনে দেয় মানুষের হাতের মুঠোয়। উদ্ভব ঘটে প্রোগ্রামেবল লজিক কনট্রোলার (পিএলসি) ব্যবস্থার। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংস, বায়োটেকনোলজির সঙ্গে অটোমেশন প্রযুক্তির মিশেলে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
সম্প্রতি পোশাক কারখানা মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ আয়োজিত এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমি তো প্যান্ডামিকের (করোনা) চেয়েও বেশি চিন্তা-ভাবনায় আছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে। এটা নিয়ে আমি দুই বছর ধরে কাজ করছি। মনে রাখতে হবে ১০টা টেকনোলজি আগামীর বিশ্বকে পরিচালনা করবে। আর এটা তিনভাবে সামনে এগুবে। একটা বায়োলজিক্যাল, একটা ফিজিক্যাল ও একটা ডিজিটাল। আর তিনটা সিনারিও ইমপ্যাক্ট করবে। মেশিন ও রোবট কিন্তু ব্যাপক ম্যানপাওয়ারকে রিপ্লেস করবে। যেমন জার্মানিতে বিএমডব্লিউ ও এডিডাস টোটালি রোবটিক উৎপাদনে চলে গেছে। সুতরাং আমরা হিসাব করে দেখেছি ৫৩ লাখ চাকরিজীবীকে তার চাকরি হারাতে হবে। একনেকের প্রতিটি মিটিংয়ে আমি বলি, আমাদের সক্ষমতা তৈরির মধ্যে অবশ্যই আমাদের এমন চিন্তাভাবনা বা সক্ষমতা দিতে হবে, যেগুলো আইএসও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্ট্যান্ডার্ড হতে হবে। এই ৫৩ লাখ লোককে যে চাকরি পরিবর্তন করতে হবে তার মেজর অংশ আপনাদের (পোশাক কারখানার মালিক) মধ্য থেকে হবে। সুতরাং আপনারা এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের বর্তমান পড়ালেখা ও দক্ষতা দিয়ে এটা (চতুর্থ শিল্পবিপ্লব) মোকাবিলা হবে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যে টেকনোলজি তাকে মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব। আমাদের এটা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদেও আলোচনা হয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থা ও দক্ষতা বেশি করে সেমুলেশন করতে হবে। যেমন ধরেন, আমাদের দেশে গাড়ির ড্রাইভিং শেখাবে। এ জন্য আমাদের দেশে একটি অটোমেটিক গাড়ি কিনবে। কিন্তু এই অটোমেটিক মেশিন পৃথিবীতে এখন অনেকটা সেকেলে। এখন ইলেকট্রিক বা সোলারসহ অন্যান্য গাড়ি এসেছে। আরেকটি বিষয় হলো, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে যারা মিডিয়াম ও মার্জিনাল লেভেলে আছে তাদের সার্ভাইব করাটা কঠিন। তাই কেবিনেট সিদ্ধান্ত নেয় যে আমাদের এখন থেকেই একটা প্যাকেজ নিয়ে আস্তে আস্তে প্রস্তুত হতে হবে। যাদের ছোট ও মাঝারি শিল্প আছে তাদের কীভাবে ব্যাকআপ করতে পারি এবং বড় শিল্পকে আরেকটু কীভাবে সহায়তা করতে পারি। না হলে কিন্তু টেকনোলজি যেভাবে উন্নয়ন করেছে, আমরা যদি ওই প্রযুক্তির সঙ্গে ম্যাচ না করতে পারি তাহলে আমি প্রতিযোগিতায় থাকতে পারব না। উৎপাদন খরচ আমি কোনোভাবেই মিল রাখতে পারব না। সবাই মিলেই কাজ করতে হবে।’
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে দেশে প্রচুর সেমিনার আর গোলটেবিল বৈঠক হচ্ছে। সবারই একই মত, এই বিপ্লব মোকাবিলায় অনেক কাজ করতে হবে। এআই, আইওটি, বিগ ডেটা, ব্লকচেইনের মতো জনপ্রিয় শব্দ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে সেখানে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই। আর কেবল পরিকল্পনা করলেই তো হবে না, অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের মানবসম্পদকেও যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে হবে এই পরিবর্তনের জন্য। প্রযুক্তিগত এই পরিবর্তনের কারণে আগামী ১০ বছরে অনেক পেশা হারিয়ে যেতে পারে, সঙ্গে অবশ্য যোগ হবে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র। পিডব্লিউসি জানাচ্ছে, স্বয়ংক্রিয়করণ প্রযুক্তির জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৮০ কোটি বর্তমান চাকরি হারিয়ে যাবে। স্বভাবতই বাংলাদেশর মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো বিপদে পড়বে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি, ব্লকচেইন এসব প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ এখনো শিশু পর্যায়ে। এসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পণ্য সরবরাহ, চিকিৎসা, শিল্পকারখানা, ব্যাংকিং, কৃষি, শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে কাজ করার পরিধি এখনো তাই ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত। সত্যিকার অর্থে যেহেতু তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সুফলই বাংলাদেশ সবার কাছে পৌঁছাতে পারিনি, চতুর্থ বিপ্লব মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুতি ক্লাসের পিছিয়ে পড়া ছাত্রের মতোই।
এসডব্লিউ/মিই/২২১০
আপনার মতামত জানানঃ