বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনগুলোর ইতিহাসে উমামা ফাতেমার নামটি একসময় ছিল একটি পরিচিত প্রতীক—আন্দোলনের মুখপাত্র, সাহসী কণ্ঠ, এক স্বপ্নবিলাসী ছাত্রনেত্রী। কিন্তু আজ, নিজ মুখে সেই উমামাই বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ছিল তাঁর জীবনের এক ‘ট্র্যাজিক’ অভিজ্ঞতা। দুই ঘণ্টা ২৪ মিনিটের দীর্ঘ এক ফেসবুক লাইভে তিনি শুধু নিজের হতাশার কথা জানাননি, বরং তুলে ধরেছেন এমন সব অভিযোগ ও অভিজ্ঞতা, যা শুধুই ব্যক্তি-কেন্দ্রিক নয়, বরং গোটা আন্দোলনের শুদ্ধতা, নৈতিকতা এবং ভবিষ্যৎকে নিয়েই প্রশ্ন তোলে।
উমামা ফাতেমার ভাষ্যমতে, জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। মানুষের রাস্তায় নেমে আসা, গণদাবির ঝড়, এবং রাষ্ট্রীয় অবিচারের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জাগরণ—সবকিছু মিলিয়ে তা ছিল যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। অথচ, সেই ইতিহাসের বুকেই লেখা হয়ে গেল বিশ্বাসঘাতকতার এক অধ্যায়। তিনি বলেন, “আমি যখন মুখপাত্র হই, তখন প্রথম আবিষ্কার করি, এই আন্দোলনের ব্যানার ব্যবহার করে কিছু মানুষ কীভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করছে। টেন্ডার বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্য, ডিসি নিয়োগের নাম করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়—এসব কিছু এত স্বাভাবিকভাবে হচ্ছিল যেন এগুলোই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য।”
তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে, কিভাবে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়টি একটি রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হয়। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরদিন থেকেই নাকি কেউ কেউ এই পরিচয় ব্যবহার করে শুরু করেন এলাকা দখল, ক্ষমতা কায়েম এবং চাঁদাবাজির মতো কর্মকাণ্ড। উমামা বলেন, “এত দ্রুত কীভাবে একটা পরিচয় এমন ভয়ংকরভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, তা দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল, রক্ষীবাহিনীর মতো কোনো ‘সমন্বয়কবাহিনী’ গড়ে উঠছে।”
এই ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখি হয়ে উমামা ফাতেমা আন্দোলনের কাঠামোকে বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রস্তাব দেন। তিনি চান, নেতৃত্বের ভার যেন কিছু উপদেষ্টার বাড়ির বৈঠকখানা থেকে সরিয়ে গণ-শক্তির হাতে আসে। কিন্তু এমন প্রস্তাবই তাঁকে করে তোলে একাংশের চোখে ‘অপরাধী’। তাঁকে অভিযুক্ত করা হয় প্ল্যাটফর্ম দখলের চেষ্টার অভিযোগে। অথচ, উমামার নিজের ভাষ্যে, “আমি এটাকে সবসময় দায়িত্ব হিসেবে দেখেছি, ক্ষমতার খেলা হিসেবে নয়। এই প্ল্যাটফর্ম আমার কাছে কোনো ‘মানি মেকিং মেশিন’ ছিল না।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তাঁর সময়কালটি ছিল হতাশা, মানসিক চাপে ভরা এক অধ্যায়। একদিকে নিজের আদর্শ, অন্যদিকে সহকর্মীদের ভিন্ন উদ্দেশ্য—এই দ্বন্দ্বে তিনি ক্রমশ একা হয়ে পড়েন। লাইভে কান্নাজড়িত কণ্ঠে উমামা বলেন, “আমি মাসের পর মাস স্ট্রেসের মধ্যে গিয়েছি। কোনো কিছুর কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। চাঁদাবাজির অভিযোগ, স্বজনপ্রীতির ছায়া—সবকিছু মিলিয়ে মনে হতো আমি কোনো নোংরা প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে গেছি।”
উমামার অভিযোগ অনুযায়ী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় সংগঠনের নামে চলত দখল ও চাঁদাবাজির সংস্কৃতি। তিনি বলেন, “শুধু চট্টগ্রামের কাহিনি ধরতে গেলেও অনেকের প্যান্ট খুলে যেত। আরেকটু এগোলে আরও অনেক জেলার কাহিনি বের হয়ে আসত।” এসব দুর্নীতির উৎস খুঁজতে গিয়েই তিনি বুঝতে পারেন, এই সমস্যাগুলো এখন ব্যক্তি নয়, কাঠামোগত রূপ নিয়েছে।
লাইভে একাধিকবার তিনি প্রশ্ন তোলেন, এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে আত্মসম্মানের জায়গা নেই, যেখানে আদর্শের বদলে চাল চলে সুবিধাবাদের, সেখানে থেকে যাওয়া কি উচিত? তাঁর মতে, “ন্যূনতম আত্মসম্মান আছে এমন কেউই এই প্ল্যাটফর্মে টিকতে পারবে না। এটা আমার জীবনের এক ট্র্যাজিক ঘটনা হয়ে থাকবে।”
উমামার মতে, আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত প্রতিরোধ। কিন্তু এক সময় দেখা গেল, অনেকে এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করছেন নিজের ক্যারিয়ার তৈরিতে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি বা প্রভাব খাটানোর কাজে। এই সৎ ও কঠোর স্বীকারোক্তিই হয়তো আজকের ছাত্ররাজনীতির দুঃখজনক বাস্তবতা।
উমামা স্পষ্ট করে বলেন, অর্থ বা খ্যাতির অভাব তাঁর ছিল না। “আমি একটা ভালো পরিবার থেকে আসি। আমার ভালো CGPA আছে, ভালো সাবজেক্টে পড়েছি। আমার পরিবার আমাকে কখনো টাকার মেশিন হিসেবে দেখে না। তারা চায় আমি দেশের জন্য কিছু করি।” এই কথার মধ্য দিয়েই তিনি বুঝিয়ে দেন, তাঁর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মূলেই ছিল নিঃস্বার্থ চেতনা—যা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভেসে গেছে রাজনৈতিক সুবিধার জোয়ারে।
উমামা ফাতেমার এই লাইভ কেবল এক তরুণ নেত্রীর ব্যক্তিগত যন্ত্রণার দলিল নয়, বরং তা হলো একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতির নগ্ন চেহারা প্রকাশের সাক্ষ্য। ছাত্র আন্দোলন, যা একসময় ছিল আদর্শিক লড়াইয়ের প্রতীক, আজ তার অনেকখানিই ব্যবহৃত হচ্ছে টাকার, পদ-পদবির ও রাজনৈতিক যোগাযোগের সিঁড়ি হিসেবে। উমামা ফাতেমা সেই ব্যবস্থার অংশ হয়ে ওঠেননি, তাই হয়তো তিনিই একা, তিনিই বিতর্কিত—তবে তিনিই হয়তো সবচেয়ে সত্যভাষী।
এই সত্যভাষণের পর এখন প্রশ্ন একটাই—এখনো কি ছাত্র আন্দোলন মানে আদর্শের লড়াই? নাকি তা হয়ে গেছে কেবল আরেকটি রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বানানোর মঞ্চ? উমামা ফাতেমার লাইভ সে প্রশ্নের উত্তর দেয় না, তবে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে যায়, যা হয়তো আরও অনেকের মুখ খুলতে সাহস জোগাবে।
আপনার মতামত জানানঃ