বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছোট্ট কোনো বক্তব্যও বড় আকারের আলোচনার জন্ম দিতে পারে—এবার তার উদাহরণ হলো অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার ‘হাঁসের মাংস’ বিতর্ক। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একটি মন্তব্য ঘিরে তিনি আবারও সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ঘটনা অনুযায়ী, উপদেষ্টা ভুঁইয়া একটি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, রাতের কাজ শেষে মাঝে মাঝে তিনি পূর্বাচলের নীলা মার্কেটে বা গুলশানের অভিজাত ওয়েস্টিন হোটেলে রাতের খাবার খেতে যান, যেখানে বিশেষত হাঁসের মাংস পাওয়া যায়।
এই মন্তব্য মুহূর্তেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলেছেন—সরকারের একজন উপদেষ্টার বেতন-ভাতার সঙ্গে অভিজাত হোটেলে যাওয়ার জীবনধারা কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতীতে তার দামি জুতা, বিমানবন্দরে হ্যান্ডব্যাগে গুলির ম্যাগাজিন থাকার মতো ঘটনার কারণে তিনি সমালোচনার শিকার হয়েছেন। এ সব বিষয়ও এখন আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।
উপদেষ্টা নিজেই বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি সত্য ঘটনাই বলেছেন এবং এতে কোনো অবৈধ বা অনৈতিক দিক নেই। তিনি দাবি করেছেন, “আমাদের জেনারেশনের অনেকেরই রাত জাগার অভ্যাস আছে। অনেক সময় কাজের জন্য মধ্যরাত বা ভোর পর্যন্ত বাইরে থাকতে হয়। এ সময় পরিবারের কেউ সজাগ থাকে না, তাই বাইরে থেকে খাবার আনা বা খাওয়া স্বাভাবিক।” তিনি আরও বলেছেন, নীলা মার্কেটে যাওয়াই বেশি, শুধু কখনও সেখানে বন্ধ থাকলে ওয়েস্টিন হোটেলে গেছেন এবং এটি খুব কম ঘটেছে।
সমালোচনার এক অংশকে আসিফ শ্রেণিঘৃণার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, সমাজে এখনো কিছু মানুষদের মধ্যে পুরনো কলোনিয়াল মানসিকতা বিরাজ করে, যারা নিজেদের বলয় বা বিশেষ শাসকগোষ্ঠী ছাড়া অন্যদের ‘অচ্ছুৎ’ মনে করেন। তিনি বলেছেন, তিনি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা একজন ব্যক্তি হিসেবে সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের প্রতিনিধি, যারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন।
সরকারের উপদেষ্টাদের বেতন-ভাতার প্রসঙ্গও আলোচনায় এসেছে। আইন অনুযায়ী, একজন উপদেষ্টা মন্ত্রীর সমপর্যায়ের বেতন পান, যা মাসিক এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা। এছাড়া দৈনিক ভাতা, নিয়ামক ভাতা, মোবাইল ফোনের জন্য সহায়তা এবং সরকারি গাড়ি ও অন্যান্য সুবিধা থাকে। এই সুযোগ-সুবিধা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে, বিশেষ করে অভিজাত হোটেলে যাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে।
এ ঘটনা শুধু সামাজিক মাধ্যমে ট্রল বা মিম তৈরি নয়, রাজনৈতিক নেতাদেরও সমালোচনার মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ফেসবুকে লিখেছেন, “এক সময় ভাত খুঁজতো ক্যান্টিনে, এখন হাঁস খুঁজে ওয়েস্টিনে।” আসিফ মাহমুদের প্রতিক্রিয়া অনুযায়ী, তিনি কোনো অবৈধ বা অনৈতিক কাজ করেননি এবং সামাজিক মিডিয়ায় সমালোচনা মূলত শ্রেণিভিত্তিক।
এই ঘটনাটি বাংলার রাজনীতিতে স্বচ্ছতা, সামাজিক পার্থক্য এবং মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। রাতের খাবারের পছন্দ বা অভিজাত হোটেলে যাওয়ার বিষয়গুলো শুধু ব্যক্তিগত নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমান সময়েও, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের দৈনন্দিন জীবন নানা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে এবং সামাজিক মিডিয়া তা আরও দ্রুত ও বৃহৎ করে তোলে।
এই ফিচারে দেখা যায়, একজন সরকারি উপদেষ্টার ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক অভ্যাস কিভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমালোচনার সঙ্গে যুক্ত হয়। একই সঙ্গে এটা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজে ক্ষমতার সঙ্গে বিলাসী জীবনধারার কোনো সংযোগ থাকলে তা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ