বাংলাদেশে কর নিয়ে মানুষের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। আয়কর থেকে ভ্যাট—সব ক্ষেত্রেই করদাতারা প্রায়শই প্রশ্ন তোলেন, তারা যে ট্যাক্স দেন তা আসলেই কোথায় ব্যয় হয়? সরকারি সেবা, অবকাঠামো কিংবা জনকল্যাণে এর প্রতিফলন তারা খুঁজে পান না। অথচ ইতিহাস বলছে, কর মানবসভ্যতার শুরু থেকেই রাষ্ট্র ও সমাজ চালানোর অন্যতম প্রধান ভিত্তি। হাজার বছর আগেও মানুষকে বিভিন্ন অদ্ভুত কর দিতে হতো—কখনো শস্যে, কখনো পশুতে, আবার কখনো একেবারেই অবিশ্বাস্য কিছুতে, যেমন প্রাচীন রোমে প্রস্রাবের জন্যও কর আদায় হতো।
মেসোপটেমিয়াকে বলা হয় কর ব্যবস্থার জনক। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে সুমেরীয় নগররাষ্ট্রগুলোতে কৃষকের শস্য, পশু, মাছ ধরার অংশ কিংবা শ্রম দিয়েই কর মেটাতে হতো। সেই সময় কাদার ফলকে করের হিসাব লিখে রাখত কর্মকর্তারা। এভাবেই কর হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্র সংগঠনের অপরিহার্য অংশ।
প্রাচীন মিসরে কর ছিল ফারাও শাসনের প্রাণভোমরা। নীলনদের প্লাবনের পর জমি মেপে কৃষকদের ওপর কর বসানো হতো। গম, যব বা গবাদি পশুই ছিল করের মূল মাধ্যম। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, পিরামিড নির্মাণে যে বিপুল সম্পদ ও শ্রম ব্যয় হয়েছিল, তার বড় অংশ এসেছিল জনগণের কর থেকে। কর ফাঁকি দেওয়া মিসরে ভয়ংকর অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো।
গ্রিসে করের চরিত্র ছিল আলাদা। এথেন্সের মতো নগরে ধনীদের দিয়ে “লিটার্জি” নামের কর নেওয়া হতো, যা জনকল্যাণমূলক কাজে খরচ হতো—নাট্যমঞ্চ, উৎসব কিংবা যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে। সাধারণ নাগরিকদের ওপর সরাসরি ভারী কর চাপানো না হলেও বাণিজ্যে শুল্ক বসানো হতো। আবার যুদ্ধকালে বিশেষ জরুরি কর চালু ছিল।
ভারতে কর ছিল শাস্ত্রনির্ভর। মনুস্মৃতি ও চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে কর আদায়ের নিয়ম লিপিবদ্ধ আছে। কৃষকের শস্যের ষষ্ঠাংশ কর হিসেবে নেওয়া হতো। ব্যবসা, সোনা-রূপা, লবণ, এমনকি কাফেলা পর্যন্ত করের আওতায় ছিল। অর্থশাস্ত্রে কর আদায়ের নীতি বলা হয়েছিল মৌমাছির মতো—“যেভাবে মৌমাছি ফুল থেকে মধু নেয় কিন্তু ফুলকে বিনষ্ট করে না, শাসকও তেমনি কর নেবে।”
চীনে হান রাজবংশের আমলে কর ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার কেন্দ্র। কৃষিজমির আকার অনুসারে কর ধার্য হতো। পাশাপাশি লবণ, লোহা, মদ ইত্যাদির ওপর বিশেষ কর ছিল। কর সংগ্রহের অর্থ ব্যবহার হতো সেচব্যবস্থা উন্নয়ন, মহাপ্রাচীর নির্মাণ আর বিশাল প্রশাসনিক কাঠামো চালাতে। তবে দুর্নীতিগ্রস্ত কর-সংগ্রাহকদের কারণে জনগণের অসন্তোষও তীব্র ছিল।
সবচেয়ে বিস্ময়কর করের উদাহরণ পাওয়া যায় প্রাচীন রোমে। রোমানদের করব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত উন্নত—জমির কর, সম্পত্তির কর, দাসের কর, উত্তরাধিকার কর—সব কিছুতেই কর দিতে হতো। কিন্তু সম্রাট ভেসপাসিয়ানের আমলে চালু হয় এক অদ্ভুত কর—প্রস্রাব কর। শহরের পাবলিক ইউরিনাল থেকে সংগৃহীত প্রস্রাব কিনত ব্যবসায়ীরা, কারণ এতে থাকা অ্যামোনিয়া কাপড় ধোয়া ও চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে কাজে লাগত। সম্রাট ঘোষণা দিলেন, এই প্রস্রাব ব্যবসা থেকে লাভ করলে আগে রাষ্ট্রকে কর দিতে হবে। তাঁর ছেলে টাইটাস আপত্তি করলে ভেসপাসিয়ান এক মুদ্রা হাতে তুলে ধরে বলেছিলেন—“অর্থের কোনো দুর্গন্ধ নেই।” এখান থেকেই জন্ম নেয় বিখ্যাত লাতিন প্রবাদ Pecunia non olet—“টাকার কোনো দুর্গন্ধ নেই।”
এই দীর্ঘ ইতিহাস দেখায়, কর কেবল অর্থ সংগ্রহের মাধ্যম ছিল না, বরং রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও শৃঙ্খলার প্রতীক। কৃষির অতিরিক্ত উৎপাদন থেকে শুরু করে বাণিজ্য আর শিল্প—সব কিছুকে করের আওতায় আনা হয়েছিল। আজকের দিনে আয়কর, ভ্যাট বা কাস্টমস শুল্ক মূলত সেই প্রাচীন ব্যবস্থার উত্তরাধিকার।
বাংলাদেশে কর আদায়ের ক্ষেত্রে অনেকেই অভিযোগ করেন স্বচ্ছতার অভাব, দুর্নীতি আর অকার্যকারিতার বিরুদ্ধে। কিন্তু ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়, কর ছাড়া কোনো রাষ্ট্রই টেকসই হয়নি। মেসোপটেমিয়ার নগররাষ্ট্র হোক, মিসরের ফারাও হোক, কিংবা রোমান সাম্রাজ্য—সবখানেই কর ছিল রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর প্রধান জ্বালানি। পার্থক্য শুধু একটাই—কোথাও কর জনগণের কল্যাণে ব্যয় হয়েছে, আবার কোথাও তা শাসকের বিলাসিতা মেটাতে গিয়েছে।
আজকের বিশ্বেও কর নীতি নিয়ে বিতর্ক থেমে নেই। তবে এক সত্য বদলায় না—সভ্যতার মতোই করও চিরন্তন।
আপনার মতামত জানানঃ