ঢাকার গুলশানে সাবেক এক এমপির বাড়িতে গিয়ে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই ঘটনাটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়, বরং সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনা বিরোধী গণআন্দোলনের ব্যানারে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলোর ভেতরে ক্রমবর্ধমান দুর্বৃত্তায়নের একটি পরিষ্কার প্রতিফলন। যেসব প্লাটফর্ম একসময় ছাত্র নেতৃত্ব ও আদর্শিক সংগ্রামের প্রতীক ছিলো, এখন সেই একই নামধারী নেতারাই ধরা পড়ছেন চাঁদাবাজির মতো অপরাধে।
প্রথম আলোচনায় আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ এবং এনসিপির মতো সংগঠনগুলোর কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ। এই তিনটি সংগঠনই শেখ হাসিনার সরকার পতনের আন্দোলনে সরব ছিলো। কিন্তু আন্দোলনের সাফল্য ও জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে একশ্রেণির লোক ‘সমন্বয়ক’ নাম ব্যবহার করে গড়ে তুলেছে একপ্রকার মব সংস্কৃতি, যেখানে ক্ষমতা ও পরিচিতি ব্যবহার করে ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, এমনকি সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও অর্থ আদায় করা হচ্ছে।
গুলশানে আটক হওয়া পাঁচজনের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রিয়াদ, যিনি গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতাও ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে শুধু চাঁদাবাজিই নয়, আগেও বিভিন্ন সহিংস আচরণ ও নারী সদস্যদের হেনস্তার অভিযোগ ছিলো। সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমার ফেসবুক পোস্ট অনুযায়ী, রিয়াদের মতো নেতারা শুধু রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে নয়, সচিবালয় পর্যন্ত প্রটোকল পেতেন, অথচ এসব বিষয় সংগঠনের অভ্যন্তরে অনেক আগে থেকেই অনেকে জানতেন। কিন্তু সাংগঠনিক ব্যবস্থা ছিলো অকার্যকর বা ছিলো না বললেই চলে।
এই চাঁদাবাজ চক্র একদিনে গড়ে ওঠেনি। গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে সাভার, ফেনী, খুলনা ও ধানমণ্ডিতে এই ‘সমন্বয়ক পরিচয়ধারীদের’ বিরুদ্ধে একাধিক ঘটনা ঘটেছে। কখনও বাড়িতে ঢুকে মব তৈরি করে চাঁদা দাবি, কখনও মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কাছে টাকা আদায়, কখনও আবার ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়ের ঘটনা সামনে এসেছে। সবগুলোতেই একটি মিল— আন্দোলনের প্লাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা।
এনসিপি, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এখন দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন। কেউ বলছেন, এসব ব্যক্তি আন্দোলনের সময়ই জড়িয়েছিলেন, এখন তাদের কাজের দায় নিতে হচ্ছে। কেউ বলছেন, সংগঠনের ভেতর অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছিলো, যাচাই-বাছাই করা হয়নি। কেউ আবার বলছেন, আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এত অভিযোগ, এত ঘটনা, তবু কেন এমন ব্যবস্থা আগে নেওয়া হয়নি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ সমাজবিদ্যাবিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলছেন, এই ধরনের অপরাধ সংগঠনের ভেতরই জন্ম নিচ্ছে এবং সংগঠনগুলো দৃশ্যমান কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে। তাঁর মতে, শুধু পদ স্থগিত বা বহিষ্কার নয়, এইসব অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এই অপরাধ আরও বাড়বে এবং রাজনীতির নাম করে দুর্বৃত্তরা সমাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।
বিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে ধরা পড়ছে এই নেতৃত্বহীনতা ও নিয়ন্ত্রণহীনতা। অনেকেই আন্দোলনের সময় ব্যানারের তলায় এসেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তারা সেই ব্যানারকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে চালিয়েছেন নিজের ব্যবসা ও স্বার্থের খেলা। এনসিপি ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কথিত ‘সমন্বয়কদের’ বিরুদ্ধে একাধিক অডিও, ভিডিও ফাঁস হয়েছে—যেখানে তাদের চাঁদার পরিমাণ, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতার ব্যবহার স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে।
তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সংগঠনগুলোর বক্তব্যে একধরনের ‘নিজেদের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার’ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কেউ বলছেন, ‘আমরা তো সবাইকে চিনি না’, কেউ বলছেন ‘অনেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পরিচয়ে ক্ষমতা নিয়েছেন’, কেউ বলছেন ‘দলীয় ফিল্টারিং ব্যর্থ হয়েছে’। কিন্তু এসব ব্যর্থতা কি শুধুই দুর্ঘটনা, নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উপেক্ষা?
আর এখানেই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠছে—আন্দোলনের নামে যারা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে, তারা কি আদৌ এই ব্যানারকে সমাজ পরিবর্তনের জন্য ব্যবহার করছিলো? নাকি এ ছিলো শুধু ক্ষমতার দরজা খুলে দেওয়ার একটি পথ?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একসময় যে নৈতিক উচ্চতায় দাঁড়িয়েছিল, এখন সেটি প্রশ্নবিদ্ধ। এনসিপি নেতা মাহিন সরকার নিজেই বলছেন, ‘এই ব্যানার আর থাকার প্রয়োজন নেই’। যদিও একই ব্যক্তিই এর প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন, আজ তিনিই প্রকাশ্যে বলছেন ব্যানার প্রত্যাহারের কথা।
এই অসহিষ্ণুতা, অনিয়ম ও অপরাধের মধ্যে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোথায়? যারা একসময় মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলো, তারা যদি নিজেরাই অন্যায়ের প্রতীক হয়ে ওঠে—তবে ভবিষ্যতের ছাত্র রাজনীতি বা গণআন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে কোথায়?
এখন প্রয়োজন দৃশ্যমান, শক্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। ‘সমন্বয়ক’ নামের অপব্যবহার, ছাত্র রাজনীতির নাম করে অর্থ আদায়, এবং রাজনৈতিক ব্যানারের আড়ালে অপরাধ—এসবের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে গণআন্দোলনের পথও হবে দুর্বৃত্তায়নের আঁতুড়ঘর।
না, স্বপ্ন শেষ হয়নি, কিন্তু সেই স্বপ্ন রক্ষা করার দায়িত্ব এখন আর ব্যানার বা প্লাটফর্মের নয়—দায়িত্ব এখন জনগণের, সচেতন ছাত্রসমাজের এবং সাহসী নেতৃত্বের। কারণ যারা স্বপ্ন বিক্রি করে নিজেদের পকেট ভরতে চায়, তাদের হাতে ভবিষ্যৎ তুলে দেওয়া যায় না।
আপনার মতামত জানানঃ