গোপালগঞ্জের মতো রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর এলাকায় এক নতুন রাজনৈতিক দলের ওপর এই ধরনের প্রকাশ্য হামলা অনেক প্রশ্ন তুলেছে। আজ দুপুরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর শহরের কেন্দ্রস্থলে যেভাবে দলটির নেতা-কর্মীদের ঘিরে হামলা চালানো হয়েছে, তাতে রাজনৈতিক সহনশীলতা আর প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিয়ে আবারও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
জানা যায়, শহরের পৌর পার্কে আজ বেলা পৌনে তিনটার দিকে এনসিপির সমাবেশ শেষ হতেই একদল মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ঘিরে ফেলে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, চারদিক থেকে নেতা-কর্মীদের ও পুলিশ বাহিনীর গাড়িকে ঘিরে আক্রমণ চালানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও সেনাবাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। তবে এনসিপি অভিযোগ করেছে, প্রশাসনের এই প্রতিক্রিয়া ছিল দেরিতে ও অসম্পূর্ণ। তাদের ভাষায়, পুলিশ বরং নিষ্ক্রিয়ই ছিল হামলার প্রথম দিকটায়।
এর আগে দুপুর দেড়টার দিকেও একই এলাকায় ২০০ থেকে ৩০০ জন মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলে পুলিশ আদালত ভবনের আশ্রয় নেয় এবং নেতা-কর্মীরা দৌড়ে সরে যান। হামলাকারীরা মঞ্চ ভাঙচুর করে, ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। এনসিপি’র কেন্দ্রীয় নেতারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিলেও সমাবেশ শেষে ফের হামলার মুখে পড়েন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও এনসিপি কর্মীদের প্রতিরোধে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
এসব ঘটনার পটভূমিতে আরও একটি গুরুতর বিষয় হলো সকালেই গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার খাটিয়াগড় চরপাড়ায় এনসিপির পদযাত্রাকে ঘিরে পুলিশের গাড়িতে হামলা ও আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনা। এতে তিনজন পুলিশ সদস্য আহত হন। পরবর্তীতে সেই এলাকা পরিদর্শনে যাওয়া ইউএনও এম রাকিবুল হাসান নিজেও হামলার শিকার হন এবং তাঁর গাড়ির চালক আহত হন। অর্থাৎ, গোপালগঞ্জে আজকের দিনটি হয়ে ওঠে একাধিক সহিংসতার কেন্দ্রবিন্দু।
জেলা প্রশাসন শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেছে, যার মাধ্যমে সব ধরনের জনসমাগম, মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি আগেভাগেই করা যেত না? কেন এনসিপিকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হলো, আবার একইসঙ্গে সেই কর্মসূচিকে ঘিরে প্রশাসন এতটা অপ্রস্তুত রইল?
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ এসেছে এনসিপির পক্ষ থেকে—যেখানে মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী সরাসরি আওয়ামী লীগের কর্মীদের এই হামলার জন্য দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী বরং নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে এবং তাঁদের আগেই জানানো হয়েছিল সবকিছু নিরাপদ। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটা দেখা গেছে।
গোপালগঞ্জ, বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান, ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র শক্তির জায়গা হিসেবে পরিচিত। সেই জায়গায় একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির পদার্পণ, তা–ও সমাবেশ করে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে, স্পষ্টতই শাসক দলের অনেকের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এনসিপি বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘জুলাই দেশগড়ার পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছে, যার আজকের গন্তব্য ছিল গোপালগঞ্জ। গতকাল তারা ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েছিল, “মার্চ টু গোপালগঞ্জ”—যা ছিল এক প্রতীকী রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে হামলা, গাড়ি পোড়ানো, প্রশাসনের ওপর আক্রমণ—সব মিলিয়ে বিষয়টি শুধুই নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন নাকি বিরোধী শক্তির উত্থান ঠেকানোর কৌশল, সে বিতর্কও তীব্র হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এনসিপি নানা রাজনৈতিক বক্তব্য ও কর্মসূচির মাধ্যমে আলোচনায় এসেছে। তাদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে সাধারণ মানুষ ও তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ছে বলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিশেষত, বিএনপির রাজনীতিতে স্থবিরতা ও জামায়াতের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এনসিপি একটা ‘নতুন বিকল্প শক্তি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করছে। ফলে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি এলাকায় এ ধরনের প্রচার ও পদযাত্রা অনেকেই দেখছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা হিসেবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সহিংসতা দিয়ে কি আদৌ বিরোধী দল দমন করা সম্ভব? না কি এর মধ্য দিয়েই বরং এনসিপির পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে? গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্দোলনের মাঠে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সেই শূন্যতা পূরণের খেলায় এনসিপির মতো দলগুলো এখন সামনে আসছে। কিন্তু তাদের পথ রক্তপাত আর প্রতিরোধে ভরা।
হিরোশিমা থেকে গোপালগঞ্জ—নিরাপত্তা ও রাজনীতির চেহারা আজও যেন একই ধরনের প্রশ্ন ছুড়ে দেয়: ‘ক্ষমতা’ কি নিরাপত্তার মাপকাঠি, না কি ভয়ের আরেক নাম?
আপনার মতামত জানানঃ