রাত তিনটার সিদ্ধান্ত আর সকাল দশটার পরীক্ষা—এই দুইয়ের ব্যবধান শিক্ষার্থীদের মনে ছাপ ফেলে গেল এক বিভ্রান্তিকর অধ্যায় হিসেবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার এই অধ্যায়টি যেন ভবিষ্যতের একটি বড় পাঠ হয়ে থাকবে, ঠিক যেভাবে দুর্যোগের রাত পরদিন সকালের পরীক্ষা প্রস্তুতিতে পরিণত হয় এক দুঃস্বপ্নে।
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা কয়েক সপ্তাহ ধরে নির্বিঘ্নেই চলছিল। ২২ জুলাই সকালে ছিল রসায়নের দ্বিতীয় পত্রসহ আরও কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষা। কিন্তু রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে বহু শিক্ষার্থীর প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে যখন গোটা জাতি শোকে স্তব্ধ, তখন একটি দ্রুত ও সুসমন্বিত সিদ্ধান্তের প্রত্যাশা ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু সেটির বদলে শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষা করছিল গভীর রাতের এক অনিশ্চিত ঘোষণা।
রাত ২টা ৪১ মিনিটে প্রথমবারের মতো একজন উপদেষ্টার ব্যক্তিগত ফেসবুক পোস্টে আসে পরীক্ষার স্থগিতাদেশের খবর। কিছুক্ষণের মধ্যে আরও দুইজন উপদেষ্টা একই তথ্য দেন ফেসবুকে। এরপর রাত তিনটার দিকে সংবাদকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপে একটি বার্তা পাঠানো হয়—পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। অথচ তখনও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। সকাল গড়িয়ে সাতটার পর আসে সরকারি ঘোষণাটি।
সেই রাতেই বহু শিক্ষার্থী ঘুমাতে পারেনি নিশ্চিত না হয়ে। কেউ ভোরে পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতিতে উঠে পড়েছিল, কেউ বা ফেসবুকে নানা পোস্ট দেখে ধন্দে পড়ে গিয়েছিল। দিনাজপুরে এমনই এক শিক্ষার্থী রংপুরে পরীক্ষা দিতে বাসে ওঠার পর এক শিক্ষকের কাছ থেকে স্থগিতের কথা শুনে বাস থেকে নেমে পড়ে। মা তখনো নিশ্চিত নন—বাঁধে দোটানা। ফেসবুকে যাচাই, ফোনে যোগাযোগ, প্রথম আলো অনলাইনে শেষ মুহূর্তে দেখা এক ঘোষণাই তাকে আশ্বস্ত করে—তবে ততক্ষণে সকালের ব্যাগ গোছানো, রওনা হওয়ার মানসিক চাপ পেরিয়ে গেছে সন্তান।
অনেক শিক্ষক পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেননি ঠিক সময়ে। কেউ কেউ পরীক্ষাকেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর জানতে পেরেছেন পরীক্ষা হচ্ছে না। কেউ কেউ এমনও ছিলেন, যারা ফেসবুকে পোস্ট দেখে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছেন। প্রশ্ন জেগেছে—এমন সিদ্ধান্তের দায় নেবে কে?
পরীক্ষা স্থগিতের মূল কারণ ছিল মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনা। এই দুর্ঘটনা যেমন জাতিকে ব্যথিত করেছে, তেমনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া আরও বেশি ব্যথিত করেছে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের। সরকারের তরফ থেকে যদি বিকেল বা সন্ধ্যায়ই পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত জানানো হতো, তাহলে এই বিভ্রান্তি এড়ানো যেত।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আজ সচিবালয় ঘেরাও করেন, লাঠিপেটার শিকার হন, কিছু জায়গায় সংঘর্ষও হয়েছে। ছাত্রদের দাবি ছিল ৯ দফা, যার মধ্যে ৫ নম্বরে উল্লেখ ছিল—রাত ৩টায় পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা অপেশাদার আচরণ। ৯ নম্বর দাবিতে বলা হয়েছে—শোক ঘোষণা করে পরীক্ষা নেওয়া ছিল প্রহসন।
শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও উঠেছে। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য ছিল—তারা আর মেরুদণ্ডহীন শিক্ষা ব্যবস্থা চায় না, চায় স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্ব।
এইচএসসি একটি পাবলিক পরীক্ষা, যার ওপর নির্ভর করে লাখো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। তাই এ ধরনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ও পদ্ধতি হতে হয় সর্বোচ্চ গুরুত্বের। গভীর রাতে পরীক্ষার স্থগিতাদেশ ঘোষণায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নাগরিকরা। অনেকে বলেছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধরণ খামখেয়ালি ও দায়িত্বহীন। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদও এমন সিদ্ধান্তকে সংবেদনশীলতাহীন ও জনবিচ্ছিন্নতার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আরও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে সরকারি ঘোষণার জটিলতা। একজন শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন—পরীক্ষার্থীরা তাঁকে ফোন করছেন ভোররাত থেকেই, কিন্তু বোর্ডের ওয়েবসাইটে কোনো ঘোষণা নেই। তখন তিনি কিছু বলতে পারছেন না, কারণ আনুষ্ঠানিক কিছু জানানো হয়নি। অথচ পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা সকাল ১০টায়, প্রবেশ করতে হয় ৯টার মধ্যে। এই সময়ের মাঝে সিদ্ধান্ত পৌঁছায়নি অধিকাংশ পরীক্ষার্থীর কাছে।
এই ঘটনার মাধ্যমে আরও একবার সামনে এলো দেশের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যর্থতা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধান উপদেষ্টা, তথ্য উপদেষ্টা, এলজিআরডি উপদেষ্টা, এমনকি আইন উপদেষ্টারাও একেক সময় একেকভাবে তথ্য দেন। কোথাও একক ও সুসংগঠিত চ্যানেল নেই। এমন পরিস্থিতিতে ফেসবুক পোস্টই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস—যেখানে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হচ্ছে।
পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না—যথার্থ ছিল। ভুল ছিল সময় নির্বাচনে, ভুল ছিল প্রচারপ্রক্রিয়ায়। সবচেয়ে বড় ভুল ছিল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে সরকারের দায়িত্বহীন আচরণ। এই ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ এখনও আছে—শুধু প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, যা আর কখনো শিক্ষার্থীদের ঘুম কেড়ে না নেয়।
আপনার মতামত জানানঃ