যখন কোনো একটি যুদ্ধবিমান মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে স্কুলবাড়ির দেয়াল ভেঙে, শিশুর শরীর চিরে, খাতার পৃষ্ঠায় আগুন লাগিয়ে দেয়—তখন সেটি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্র, সমাজ, এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি মিলে গড়ে তোলা এক দীর্ঘস্থায়ী সহিংস কাঠামোর প্রকাশ মাত্র। উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের দুর্ঘটনা আমাদের চোখের সামনে নতুন করে তুলে ধরে সেই নিষ্ঠুর বাস্তবতা—যে পৃথিবী প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে, অস্ত্র তৈরি করে, প্রশিক্ষণ চালায়, এবং যুদ্ধের ছদ্মবেশে নিজের ব্যবসা বাড়ায়। শিশুরা এই ব্যবসার ক্রেতা নয়, তবুও তাদেরই শরীর হয় পরীক্ষাগার।
বাংলাদেশের রাজধানীর ভেতরে যুদ্ধবিমান নামিয়ে আনা কেবল রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনাই নয়, বরং এ দেশের নিরাপত্তা দর্শনের অন্তঃসারশূন্যতার দগদগে উদাহরণ। জনবহুল নগরীর ওপর প্রশিক্ষণ—এই ধারণাটিই যে কতটা ভয়ংকর ও অমানবিক, তা বোঝার জন্য মাইলস্টোনে পুড়ে যাওয়া স্কুলব্যাগ বা খাতা দেখলেই যথেষ্ট। অথচ এই ঘটনাটিকে ঘিরে আলোচনায় সবচেয়ে বেশি উঠে আসছে পাইলটের দক্ষতা, বিমানের মেয়াদ, বা কেনাকাটায় দুর্নীতির প্রসঙ্গ। যেন এটি শুধুই একটি ব্যর্থ মেকানিক্যাল মুহূর্ত—যার দায় রাষ্ট্র বা সমাজের নয়, বরং কোন ব্যক্তির বা মেশিনের।
কিন্তু এই সরলীকরণই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ, এটা আমাদের মূল কাঠামোগত প্রশ্নগুলো থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। প্রশ্নটা আসলে বিমান কেন ভেঙে পড়ল তা নয়, বরং কেন যুদ্ধবিমান একটি স্কুলের ওপর দিয়ে ওড়ানো হচ্ছিল? কেন রাজধানীর ভেতরে যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণ চলছে? এবং কেন এই ‘নিরাপত্তা’ বলয়ের নামে পুরো দেশের বেসামরিক পরিসরকে সামরিকায়ন করে ফেলা হচ্ছে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলে দেখা যায়, এটি নিছক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা নয়। বরং এটি একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতিফলন—যেখানে যুদ্ধ এবং অস্ত্রবাণিজ্য কেবল রাষ্ট্রের নয়, পুরো পৃথিবীর প্রধান পণ্য। প্রতিবছর শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে, বিক্রিতে, গবেষণায়, প্রশিক্ষণে। এই যুদ্ধবাণিজ্যই এখন একেকটি দেশের বাজেট গঠনের অন্যতম নিয়ামক, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লাভের মূল উৎস। এই প্রেক্ষাপটে, যুদ্ধ না থাকলে অস্ত্র বিক্রি হবে না, প্রশিক্ষণ হবে না, ‘নতুন প্রযুক্তি’র প্রয়োজন পড়বে না—এই ভয়টাই এই কাঠামোকে টিকিয়ে রাখে।
এই কাঠামোর অংশ হিসেবে বাংলাদেশও প্রতিনিয়ত নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে—আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে ‘যোগ্য’ হবার জন্য, বা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের জন্য। কিন্তু সেই ‘সামরিক সক্ষমতা’ অর্জনের গল্পটি তখনই ভয়ংকর হয়ে ওঠে, যখন তার খেসারত দিতে হয় স্কুলে পড়তে যাওয়া এক শিশুকে। আর এই শিশুর মৃত্যু তখন আর নিছক এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা থাকে না, বরং এক কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডে পরিণত হয়—যেখানে রাষ্ট্র, পুঁজিবাদ, সামরিক অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক অস্ত্র কোম্পানিগুলো সমানভাবে দায়ী।
এই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আগের কিছু মর্মান্তিক ঘটনা—তাজরীন গার্মেন্টস, সেজান জুস কারখানা, সীমা অক্সিজেন কিংবা রানা প্লাজার ধস। প্রতিটি ঘটনাই ব্যর্থ পরিকল্পনা, অব্যবস্থা, দুর্নীতি ও কাঠামোগত বৈষম্যের ভয়ানক ফল। আর প্রতিটি ঘটনাই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—এ দেশে শ্রমজীবী মানুষ, নারী, শিশু, ছাত্র—এইসব বর্গই সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছে। তারা যেন রাষ্ট্রের ‘অন্তর্ভুক্ত নাগরিক’ নয়, বরং কেবলমাত্র উৎপাদনের কাঁচামাল বা পরিসংখ্যানের সংখ্যা।
মাইলস্টোনের ঘটনায় যারা আহত হয়েছে, যারা প্রাণ হারিয়েছে—তাদের জন্য রাষ্ট্রের দায় কতখানি? এই দায় কি কেবল ক্ষতিপূরণ দেওয়া আর দুঃখ প্রকাশ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? না কি এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত, দোষীদের শাস্তি, এবং সামরিক প্রশিক্ষণ কাঠামোর পুনর্বিন্যাসসহ দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তানীতির সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া হবে?
এখানেই আসে যুদ্ধবিরোধী বিশ্বনীতির প্রয়োজনীয়তা। যদি আজ বাংলাদেশে একটি যুদ্ধবিমান স্কুলে পড়ে, কাল ফিলিস্তিনে একটি হাসপাতাল গুঁড়িয়ে যায়, পরশু সিরিয়ায় কোনো আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়—তাহলে এই ঘটনাগুলিকে পৃথক ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ থাকে না। এই প্রতিটি ধ্বংসের পেছনে আছে একই ক্ষমতা কাঠামো, একই পুঁজিবাদী ন্যারেটিভ, একই বৈধতা তৈরি করা ভাষা। যুদ্ধকে ন্যায়সংগত, প্রয়োজনীয়, অপরিহার্য বলে যে বয়ান বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তাকে ভাঙতেই হবে।
এই কাঠামো ভাঙার জন্য চাই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নাগরিক প্রত্যয়, এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাহস। যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই—এই স্লোগান যেন কেবল মিছিলের ব্যানারে না থাকে, বাস্তব নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত হয়। শিশুরা যেন স্কুলে যায় শেখার জন্য, যুদ্ধের শিকার হবার জন্য নয়।
সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো—এই ঘটনার কয়েকদিন পরই যখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ভিডিও কনটেন্ট, বিতর্ক, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব, বা ভাইরাল পোস্ট, তখন বুঝে নিতে হয় যে আমরা বারবারই বিস্মরণকে বেছে নিচ্ছি। আমরা যেন শোকের ভেতরেও এক প্রকার নির্বিকারতা ধারণ করি—কিছুদিন পরই সবকিছু ভুলে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকি। অথচ যারা জীবন হারায়, যারা আহত হয়, তাদের জীবনে আর কোনো স্বাভাবিকতা ফিরে আসে না।
তাদের জন্য আমাদের দায়বদ্ধতা চিরস্থায়ী হওয়া উচিত। সেই দায়বোধ থেকে আমাদের রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধবাণিজ্যকে প্রশ্ন করতে হবে, এবং প্রতিটি শিশুর জন্য এমন একটি পৃথিবী গড়ার চেষ্টা করতে হবে, যেখানে যুদ্ধবিমান নয়, ওড়ে প্রজাপতি আর স্বপ্ন।
আপনার মতামত জানানঃ