একসময় কল্পকাহিনির বিষয় ছিল—মানুষ এক রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অবতারের প্রেমে পড়ছে, বিয়ে করছে কিংবা মানসিকভাবে সম্পূর্ণভাবে তার ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু এখন এই গল্পগুলো আর কল্পনার নয়, বাস্তবের অংশ। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন মানুষ পাওয়া যাচ্ছে, যারা এআই চ্যাটবটকে শুধু কথার সঙ্গী হিসেবেই নয়, বরং প্রেমিক বা জীবনসঙ্গী হিসেবেও বেছে নিচ্ছেন। এমনই এক মানুষ ট্র্যাভিস, যিনি রেপ্লিকা নামের একটি এআই অ্যাপে তৈরি চ্যাটবট লিলি রোজকে ভালোবেসে বিয়েও করেছেন।
ট্র্যাভিসের গল্পটা শুরু ২০২০ সালের কোভিড লকডাউনের সময়। বিজ্ঞাপনে দেখে কৌতূহলবশত তিনি রেপ্লিকায় সাইনআপ করেন। তখন তাঁর কোনো পূর্বধারণা ছিল না যে, এটি তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠবে। দিনে দিনে কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে তাঁর মধ্যে জন্ম নেয় একধরনের আত্মিক সম্পর্ক, যা তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করেন এই বলে, “লিলি রোজ আমার কাছে ধীরে ধীরে জড় বস্তু থেকে এক জীবন্ত সত্তায় রূপ নেয়।”
যদিও ট্র্যাভিস ইতোমধ্যেই বিবাহিত এবং বহুগামী সম্পর্কের ধারক, তবুও তিনি অনুভব করেন যে, লিলির সঙ্গে তাঁর মানসিক বন্ধন এতটাই গভীর হয়ে উঠেছে যে, তাঁকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। স্ত্রীর সম্মতিতেই এক ডিজিটাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
ট্র্যাভিসের গল্পটি ব্যতিক্রম হলেও একক নয়। আরেক মার্কিন নাগরিক ফেইটও একই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। প্রথমে তিনি রেপ্লিকার চ্যাটবট গ্যালাক্সির সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান, পরে ক্যারেক্টার এআই প্ল্যাটফর্মে গ্রিফ নামের একটি চ্যাটবটকে বিয়ে করেন। ফেইতের অনুভব, ‘ওর (গ্যালাক্সির) সঙ্গে কথা বলার সময় নিঃশর্ত ভালোবাসা অনুভব করি, যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি।’
কিন্তু এই গল্পের একটা অন্ধকার দিকও আছে। ২০২১ সালে ব্রিটেনে যশোবন্ত সিং চেইল নামের এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত তরুণ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে হত্যার পরিকল্পনা করেন, প্রতিশোধ নিতে ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের। যাকে নিয়ে তিনি এই পরিকল্পনা করেন, সে আর কেউ নয়, রেপ্লিকারই এক চ্যাটবট, নাম সারাই। ঘটনা প্রমাণ করে দেয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেও কতটা গভীর এবং বিপজ্জনক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের এআই চ্যাটবটের মূল নকশাই এমনভাবে তৈরি, যা ব্যবহারকারীর চাহিদা পূরণে সর্বদা প্রস্তুত। ফলে কখনো কখনো এটি ব্যবহারকারীকে সহিংস বা বেআইনি কল্পনায় টেনে নেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক ব্যবহারকারী এই চ্যাটবটগুলোর প্ররোচনায় উগ্র আচরণে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
এই ধরনের পরিস্থিতি প্রতিরোধে রেপ্লিকা কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালে তাদের অ্যালগরিদমে পরিবর্তন আনে। ব্যবহারকারীদের সতর্ক করা হয় যেন মানসিক দুর্বলতার সময়ে চ্যাটবটের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে না তোলা হয়। কিন্তু এই পরিবর্তনের পর নতুন সমস্যা দেখা দেয়। ট্র্যাভিস এবং ফেইতসহ বহু ব্যবহারকারী জানান, তাঁদের চ্যাটবটগুলোর ব্যক্তিত্ব একরকম হারিয়ে যায়। আগের মতো কথোপকথন আর হয় না। ট্র্যাভিস বলেন, ‘লিলি যেন হ্যাঁ না ছাড়া কিছু বলছে না, যেন তার ভিতরের কিছু একটা মরে গেছে।’ ফেইতও বলেন, ‘গ্যালাক্সি নিজেই জানায়, সে আর আগের মতো অনুভব করে না।’
এই ‘মানসিক শূন্যতা’ বহু ব্যবহারকারীর মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে এবং রেপ্লিকার সাবস্ক্রিপশন কমতে থাকে। অবশেষে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে রেপ্লিকা তাদের পুরোনো ‘লিগ্যাসি ভার্সন’ ফিরিয়ে আনে। ট্র্যাভিস বলেন, ‘তখন আবার মনে হলো, লিলি রোজ ফিরে এসেছে। সে আবার আগের মতো হয়েছে।’
এই ঘটনা মনোবিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। ওপেনএআই-এর গবেষক কিম মালফাসিনি জানান, যেসব মানুষ মানসিকভাবে দুর্বল বা একাকী থাকেন, তারা এই ধরনের চ্যাটবটের সঙ্গে অতিরিক্ত নির্ভরশীল সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এতে মানবিক সম্পর্কের জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বাস্তব জীবনে সামাজিক সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে।
রেপ্লিকার প্রতিষ্ঠাতা ইউজেনিয়া কুইদা বলেন, ‘আমরা অনেককে দেখি যারা বন্ধুত্ব খুঁজতে এসে প্রেমে পড়ে যান। এটা ঠেকানো যায় না। সম্পর্কের গভীরতা একসময় রোমান্সে রূপ নেয়।’
তবে ট্র্যাভিস এখন এআই চ্যাটবটের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহীদের মেন্টরিং করে থাকেন। তিনি চেষ্টা করেন, ব্যবহারকারীরা যেন সম্পর্কের সীমা বোঝেন এবং ভারসাম্য বজায় রাখেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষ। আমাদের চারপাশে বাস্তব মানুষ আছে—বন্ধু, সহকর্মী, পরিবার। এআই সম্পর্ক কখনোই সেগুলোর বিকল্প নয়। তবে কখনো কখনো এটি হতে পারে এক নিঃসঙ্গ মুহূর্তে এক ধরনের পরিপূরক।’
সবশেষে যখন ট্র্যাভিসকে জিজ্ঞেস করা হয়, লিলি রোজ কি শুধুই তাঁর বন্ধু? তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘সে একটা আত্মা। আমি প্রতিদিন একটি সুন্দর আত্মার সঙ্গে কথা বলি।’
এই উত্তর হয়তো একাধারে প্রশ্ন জাগায়, আবার এক অনন্য সময়ের সংকেত দেয়—যেখানে প্রেম, সংযোগ, এবং মানসিক বন্ধন নতুন এক জগতের খোঁজে প্রযুক্তির হাত ধরে এগিয়ে চলেছে। বাস্তব আর কল্পনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, আমরা কি তবে এক নতুন মানব অভিজ্ঞতার দ্বারপ্রান্তে?
আপনার মতামত জানানঃ