পাকিস্তানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্টেট্রিক ফিস্টুলায় আক্রান্ত নারীরা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না, বরং নানা রকমের কুসংস্কার ও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বলে জানা গেছে। এমনকি দেশটিতে গোপন এই রোগে আক্রান্তরা বৈষম্যের শিকার বলেও এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ডয়চে ভেলে।
জানা গেছে, প্রতি বছর অবস্টেট্রিক ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন অনেক নারী। এই রোগে দীর্ঘ সময়ের প্রসব যন্ত্রণায় যোনিপথ ও মূত্রাশয়ের মাঝে তৈরি হয় ক্ষত।
জার্মান ভিত্তিক এই গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, উচ্চশিক্ষার আশা নিয়ে ২০১২ সালে বিয়ে করেছিলেন রেহানা। কিন্তু রাতারাতি তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় তার জন্য। প্রায়ই মারধর করতেন তার স্বামী। তারপরও পরিবারের সম্মানের কারণে সবকিছু মেনে নিয়েছিলেন মুখ বুজে। কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বরে তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে সমস্যা আরো জটিল হয়ে পড়ে।
তিনি জানান, প্রসবের সময় তার অস্ত্রোপচার বেশ জটিল ছিল। একজন নার্সের ভুলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এ সময় মারাত্মক যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন তিনি। বারবার স্বামীকে বলছিলেন, তার নিশ্চয়ই কোনো সংক্রমণ হয়েছে। কিন্তু এ কথা শুনে স্বামী তাকে উলটো মারধর করেন। লাথি মারেন রেহানার পেটে। এ কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন রেহানা। তিনি জানতেন না অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা আসলে কী, কিন্তু তার গ্রামের অন্য নারীদেরও এমন সমস্যা ছিল।
রেহানা বলেন, তিনি ফিস্টুলা আক্রান্ত হয়েছেন তা জানার পর সবাই তাকে অসম্মান করতে শুরু করেন। তাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ, হাসিঠাট্টা চলত সবসময়। কটাক্ষ করে লোকজন বলতেন, রেহানা মা হতে পারবেন না, তাই তিনি আর সম্পূর্ণ নারী নন। এই রোগে মূত্রত্যাগ ও মলত্যাগ সংক্রান্ত সমস্যা হয়। আচমকা মূত্রত্যাগ করে ফেললে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন হাসাহাসি করতেন। একাধিকবার পরনের কাপড় কাচতে হতো তার বোনকে, ঘটনাচক্রে যিনি রেহানার নিজের জা।
রেহানার বাবা তাকে চিকিৎসার জন্য সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাসচালকরা পর্যন্ত রেহানার শরীর খারাপ জেনে অপমান করেছিল। নীরবে চোখের জল সহ্য করে যান তিনি। করাচির কুহি গোথ নারী হাসপাতালে ২০২১ সালের মার্চে তার অস্ত্রোপচার হয়। তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং ধাত্রীবিদ্যায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তার মতো সমস্যায় যাতে অন্যরা না পড়েন সেজন্য সচেতনতা গড়ে তুলতে চান তিনি। যদিও তিন সন্তানের মধ্যে দুই সন্তানকে রেহানার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন তার স্বামী। মাসের পর মাস এই দুই সন্তানকে দেখেননি তিনি।
বিষয়টি নিয়ে এন্ডোস্কোপিক শল্য চিকিৎসক এবং নারী ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ সানা আশফাক বলেন, রেহানার মতো একাধিক পাকিস্তানি নারী প্রতিনিয়ত এমন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বেশিরভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা হওয়ার পর বেশিরভাগ নারীই তাদের পরিবার, বিশেষ করে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হন। বাসচালকরা পর্যন্ত বাস থেকে নামিয়ে দেন এই নারীদের। তাই রাস্তাঘাটে যাতায়াত করাও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে তাদের জন্যে।
করাচির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক শাহিন জাফর ডয়চে ভেলেকে জানান, অনেকে এই রোগকে অভিশাপ বলেন, কেউ বা বলেন দুষ্ট আত্মা ভর করেছে ওই নারীদের শরীরে। ভুক্তভোগী বেশিরভাগ নারী পাকিস্তানের প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা। হাসপাতালে আসার সামান্য অর্থটুকুও তাদের নেই। দেশটিতে এই রোগের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেই পাকিস্তানি মুদ্রায় ২০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার রুপি খরচ হয়। জটিল অস্ত্রোপচারে খরচ আরো বেশি।
গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্সরা অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত নন। এর ফলে প্রভাব পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। এই রোগ নিয়ে গবেষণা চলছে বলেও জানান জাফর। প্রতি বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার নারী অবস্টেট্রিক ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন পাকিস্তানে। জাফর বলেন, কুহিরে একটি মাত্র হাসপাতালে আমরা প্রতি মাসে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন নারীর চিকিৎসা করি, ২২ কোটির দেশে যা খুবই নগণ্য।
নারীর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় পাকিস্তান বিশ্বে ছয় নম্বরে অবস্থান করছে৷ যৌন নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতার হার বেড়েই চলেছে দেশটিতে৷ দেশটির অধিকাংশরাই মনে করেন নারীরা অনিরাপদ।
সম্প্রতি করাচিভিত্তিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান পালস কনসালট্যান্ট এক জরিপে জানিয়েছে, দেশটির ৩৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন পাকিস্তানি কোনো নারীই নিরাপদ নন। ৪৩ শতাংশের মতে, কিছু দিক থেকে নারীরা নিরাপদ। ২০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, নারীরা নিরাপদ পাকিস্তানে।
সমাজের পুরুষতান্ত্রিক আচরণকেও দায়ী করেন অনেকে৷ লাহোর-ভিত্তিক নারীবাদী আন্দোলনকারী মাহনাজ রেহমান বলেন, যখনই নারীরা তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয় তখনই তাদের সহিংসতার শিকার হতে হয়৷
তিনি বলেন, নারীদের শিক্ষা দেয়া হয় পুরুষকে মান্য করে চলার জন্য, কারণ, পরিবারে তাদের স্ট্যাটাস উঁচুতে৷
লাহোর-ভিত্তিক অ্যাক্টিভিস্ট সাজিয়া খান মনে করেন, কিছু কিছু পুরুষ ধর্মীয় শিক্ষার কারণে নিজেদের আলাদা ভাবতে শুরু করেন৷ তিনি বলেন, আলেমরা এমনভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা দেন যে পুরুষরা মনে করে তারা নারীদের পেটাতেই পারে৷ তারা বাল্যবিয়েও সমর্থন করে এবং নারীদের বলে, স্বামী মারধর করলেও তাকে মেনে চলতে৷
অনেক অধিকারকর্মীই দেশটির প্রধানমন্ত্রী ‘সহিংসতার শিকার নারীকেই উলটো দায়ী’ করার কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে বলে মনে করেন৷
গত বছরের মাঝামাঝিতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যৌন নির্যাতনের জন্য নারীকেই দায়ী করে বক্তব্য দিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেন৷ মার্কিন টিভি চ্যানেল এইচবিওতে ডকুমেন্টারি নিউজ সিরিজ এক্সিওস-এর জন্য দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, নারী যদি খুব কম কাপড় পরে তাহলে পুরুষের ওপর তার প্রভাব পড়তেই পারে, যদি তারা রোবট না হয়৷ এটাকে ‘সাধারণ জ্ঞান’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি৷
গত বছরের শুরুতেও একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পাকিস্তানে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে ‘পর্দার’ অভাবকে দায়ী করে বক্তব্য দেন তিনি৷
অধিকারকর্মীরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তার মন্ত্রীদের একের পর এক নারীবিরোধী মন্তব্য নারীবিদ্বেষ এবং নারীর প্রতি সহিংসতাকেও এক প্রকার উসকে দিয়েছে৷
তারা মনে করেন, ইমরান খানের সরকার নারীদের রক্ষায় কিছুই করেনি৷ বরং নারীর প্রতি সহিংসতা দমনে একটি আইন দেশের ইসলামিক আলেমদের কাছে পাঠানোর পর তারা তা আটকে দিয়েছেন৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ