নিরাপত্তা, প্রযুক্তি ও ভূরাজনীতির জটিল অংকে গাঁথা একজন মানুষ—ড. আবদুল কাদির খান। পশ্চিমা বিশ্ব যাঁকে দেখেছে এক বিপজ্জনক চিত্র হিসেবে, কিন্তু পাকিস্তান তাঁকে দেখেছে জাতীয় গর্বের প্রতীক হিসেবে। ইসরায়েল-ভারতের যৌথ অভিযানে ব্যর্থতার পেছনের গল্পটা তাই শুধু বোমা-বারুদের লড়াই নয়, বরং এটি আদর্শ, প্রযুক্তি ও রাষ্ট্রীয় নীতির মুখোমুখি সংঘাত। ২০২৫ সালের জুনে মিডলইস্ট আইয়ের একটি প্রতিবেদন ফের সামনে এনেছে সেই রহস্যময় অধ্যায়—পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচিকে ধ্বংসে ইসরায়েল ও ভারতের ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
ড. আবদুল কাদির খানকে কেউ কেউ ‘ইসলামি বোমার জনক’ বললেও, পশ্চিমা গোয়েন্দাদের চোখে তিনি ছিলেন ওসামা বিন লাদেনের মতোই হুমকি। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রাক্তন প্রধান প্রকাশ্যে বলেছেন, সুযোগ পেলে তিনি কাদির খানকে হত্যা করতেন। এই ঘোষণাগুলো থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, খান ছিলেন কতটা ভয়ংকর এক প্রতিপক্ষ ইসরায়েল ও তার মিত্রদের চোখে।
১৯৮০-এর দশকে ইসরায়েল যখন পাকিস্তানের কাহুটা পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলার পরিকল্পনা করে, তখন ভারতের গুজরাটের জামনগরে সেই হামলার লজিস্টিক প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই পরিকল্পনায় সম্মতিও দেন। তবে শেষ মুহূর্তে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে সেই ঐতিহাসিক হামলা আর বাস্তবায়িত হয়নি। পরে ইন্দিরার পুত্র রাজীব গান্ধীর সময়েও সেনা অভিযান চালিয়ে যুদ্ধ বাঁধানোর চেষ্টা হয়, যাতে হামলা চালানোর অজুহাত তৈরি করা যায়। কিন্তু রাজীব সেই ফাঁদেও পা দেননি।
মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক ভারসাম্য নষ্ট হতে দেখছিল ইসরায়েল। তাই পাকিস্তানের পারমাণবিক অগ্রগতিকে তারা সরাসরি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। তারা শুধু হামলার পরিকল্পনায় থেমে থাকেনি, বরং ইউরোপের বিভিন্ন কোম্পানির নির্বাহীদের টার্গেট করতেও পিছপা হয়নি। জার্মানিতে এক কোম্পানির নির্বাহীর বাড়িতে বোমা পাঠানো হয়, বেঁচে যান ব্যক্তি, মরেন তাঁর কুকুর। সুইজারল্যান্ডে আরেক কোম্পানির কর্মকর্তার ওপরও হয় হামলা। এক ব্যবসায়ী জানান, মোসাদের এজেন্টরা ফোনে হুমকি দিত নিয়মিত। তবু থামেননি কাদির খান।
পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচির শুরু হয় এক নিঃশব্দ বিপ্লবের মাধ্যমে। ১৯৭৪ সালে ভারতের ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ পরমাণু পরীক্ষার পর জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দেন, পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তি অর্জন করবে। সেই প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন করেন কাদির খান। ইউরোপের ইউরেনকো কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে তিনি সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তির গোপন নকশা সংগ্রহ করেন, যা পরবর্তীতে পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতার ভিত্তি গড়ে দেয়।
খানের প্রতিভা ও কৌশলের মাধ্যমে তৈরি হয় গোপন নেটওয়ার্ক। তিনি ভুয়া কোম্পানির নামে যন্ত্রপাতি আমদানি করতেন, বাইরে বলা হতো সেগুলো টেক্সটাইল কারখানার জন্য। সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তাঁর গবেষণা ল্যাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ চলতে থাকে। আরেকদিকে, আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে তিনি প্রযুক্তি রপ্তানি করতেন ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে।
এই নেটওয়ার্কের কারণে ইরান ও উত্তর কোরিয়া পরমাণু অস্ত্রের পথে এগোয়। যদিও ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ধর্মীয় কারণে পারমাণবিক বোমার বিরোধিতা করেছিলেন, বাস্তবে ইরান সহায়তা নিয়েছিল পাকিস্তান থেকে। ২০০৩ সালে লিবিয়ার গাদ্দাফি পুরো নেটওয়ার্ক ফাঁস করে দিলে পশ্চিমা বিশ্ব খানকে চেপে ধরে। ২০০৪ সালে তিনি স্বীকার করেন, প্রযুক্তি সরবরাহে তিনি একাই দায়ী। এরপর তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় পাঁচ বছর।
এই ব্যর্থ প্রচেষ্টার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, ইসরায়েল সবাই কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল। চীন সরাসরি ইউরেনিয়াম ও বিজ্ঞানী পাঠিয়ে সাহায্য করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রও আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ ঠেকাতে পাকিস্তানকে পাশে চেয়েছিল, তাই ১৯৮০-এর দশকে চুপচাপ থেকেছে। কিন্তু ৯০-এর দশকে এসে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ততদিনে পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তি অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়।
১৯৯৮ সালের মে মাসে পাকিস্তান সফলভাবে পরমাণু পরীক্ষা চালায়, যা ভারতে পাল্টা জবাব হিসেবে বিশ্বে আলোড়ন তোলে। এই পরীক্ষার পর কাদির খান হন জাতীয় বীর। তাঁর গাড়িবহর প্রধানমন্ত্রীর মতো, তাঁর নামে স্কুল, রাস্তাঘাট, এমনকি ক্রিকেট দল গড়ে তোলা হয়। এই জাতীয় আবেগ তাঁকে দেয় অমরতা।
ড. কাদির খানের জীবনের শেষ পর্বেও তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডকে সঠিক বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, মুসলিম দেশগুলোর প্রযুক্তিগত নিরাপত্তার জন্য পরমাণু শক্তি অর্জন অপরিহার্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলিম দেশকে প্রযুক্তি দেওয়া অপরাধ নয়। তাঁর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের সর্বোচ্চ স্তর থেকে তাঁকে ‘জাতীয় প্রতীক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আপনার মতামত জানানঃ