২০২৫ সালের জুন মাসে একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্ট ঘিরে তুমুল আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ইসরায়েলের সাবেক উপ–প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং লেবার পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মেইর মাসরি। এক্স (সাবেক টুইটার)-এ আরবি ও উর্দু ভাষায় দেওয়া একটি পোস্টে তিনি বলেন, “ইরানের পর এবার আমরা পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের চিন্তা করছি।” এই মন্তব্যটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যম, কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি করে।
মেইর মাসরি বর্তমানে কোনো সরকারি দায়িত্বে না থাকলেও, ইসরায়েলি রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান খুবই প্রভাবশালী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিরাপত্তা নীতিমালা ও কৌশলগত পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করে আসছেন। তাই তাঁর মুখে এ ধরনের মন্তব্য নিছক ‘ব্যক্তিগত মতামত’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং অনেকেই এটিকে ইসরায়েলের ভেতরের নিরাপত্তা অভিসন্ধির ইঙ্গিত বলেই মনে করছেন।
এই পোস্টে মাসরি সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানকে তুলনা করে বলেন, “পাকিস্তান ইরান থেকে দূরে নয়। এতটুকু বুঝলেই যথেষ্ট।” তাঁর এই মন্তব্য অনেক বিশ্লেষকের মতে একটি স্পষ্ট হুমকি—যেখানে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে সামরিক বা কৌশলগত পদক্ষেপের পর পাকিস্তানকেও একই ছকে ফেলার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এতে বোঝা যায়, ইসরায়েলের দৃষ্টিতে পাকিস্তান শুধু ইরানের ‘বন্ধু’ নয়, বরং পরমাণু শক্তিধর একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে তাদের কৌশলগত উদ্বেগের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অনেকে মাসরির বক্তব্যকে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে একটি একতরফা ও ভয়ানক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন। কেউ কেউ আবার লেখেন, “এমন হুমকি দিয়ে পাকিস্তানিদের মনোবল ভাঙা যাবে না, বরং তা আরও দৃঢ় হবে।” আরেকজন টুইটার ব্যবহারকারী লেখেন, “ইসরায়েল যেন ভুলে না যায়, পাকিস্তানের পারমাণবিক নীতিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতিশ্রুতি থাকলেও আত্মরক্ষায় আমরা কখনো পিছপা হব না।”
ইসরায়েলি পক্ষের এই হুমকির জবাবে পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্বও চুপ করে থাকেনি। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এক শক্ত প্রতিক্রিয়া দিয়ে বলেন, “ইসরায়েলের জন্য আমাদের বার্তা স্পষ্ট, পাকিস্তানের দিকে তাকানোর সাহস কোরো না। পাকিস্তান সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে এবং যেকোনো আগ্রাসনের জবাব দিতে প্রস্তুত ও সক্ষম।” তিনি আরও বলেন, “ভারতের সঙ্গে পূর্ববর্তী উত্তেজনার সময় আমরা যেমন জাতিগত ঐক্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি, এবারও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকবে।”
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান কেবল নিজের পারমাণবিক ক্ষমতা বা সামরিক প্রস্তুতির কথা বলছে না, বরং কূটনৈতিকভাবে একটি বার্তাও দিচ্ছে—তারা কোনোভাবেই যুদ্ধ চায় না, কিন্তু প্রয়োজন হলে তাদের জবাব প্রস্তুত। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের অতীত নীতির দিকেও দার ইঙ্গিত করেন—যেখানে পারমাণবিক শক্তিকে শান্তির ভারসাম্য রক্ষার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, কখনো আগ্রাসনের অস্ত্র হিসেবে নয়।
এই উত্তেজনার মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে—যদি ইরানে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালায়, তাহলে পাকিস্তান ইসরায়েলের ওপর পারমাণবিক হামলা করতে পারে। যদিও এই গুজব সরাসরি অস্বীকার করেছে পাকিস্তান সরকার, কিন্তু এটি স্পষ্ট যে জনমনে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন গুজব শুধুই সাধারণ মানুষের আতঙ্কের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটাও বোঝায় যে দক্ষিণ এশিয়ায় পরমাণু অস্ত্রকে ঘিরে একটি দৃষ্টান্তমূলক সতর্কতা সবসময় বিরাজ করে।
তবে এই উত্তেজনার সময় আরেকটি ঘটনাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে—পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আপ্যায়ন। এই ঘটনাটি মাসরির মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ঘটে, এবং অনেকেই এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভারসাম্য নীতির অংশ হিসেবে দেখছেন। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে সামলাতে চাইছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, এটি ইসরায়েলকে বার্তা দিতে পারে—যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে কোনো অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ানোর পক্ষপাতী নয়।
বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান বাস্তবতায় এটি স্পষ্ট যে, ইসরায়েল, ইরান ও পাকিস্তান—এই তিনটি দেশ এখন একধরনের পারমাণবিক দৃষ্টিপাতে যুক্ত হয়ে পড়েছে। ইসরায়েল বরাবরই চায় না মুসলিম বিশ্বের আর কোনো দেশ তাদের মতো পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠুক। তাই ইরানের পর পাকিস্তানকেও তারা সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পাকিস্তান ১৯৯৮ সাল থেকেই একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র এবং আজ পর্যন্ত তারা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করেনি। বরং ভারতের সঙ্গে দীর্ঘকালীন সীমান্ত উত্তেজনার মাঝেও তারা একটি নিরুত্তাপ কৌশল অনুসরণ করেছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া এমনকি মুসলিম বিশ্বকেও শান্তি ও সংযমের বার্তা দিতে হবে। কারণ পারমাণবিক হুমকি কখনোই কোনো সমস্যার সমাধান নয়, বরং তা মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ।
সবশেষে বলা যায়, মেইর মাসরির মন্তব্য একটি ঝড় তো তুলেছে, কিন্তু সেটি শান্তির নয়, ভয় ও উত্তেজনার। এখন সময় এসেছে, কূটনীতিকে সামনে এনে রাজনৈতিক বিবেচনায় শান্তি ও সহাবস্থানের পথ খুঁজে বের করার। কারণ বিশ্ব আরেকটি পারমাণবিক সংঘাতের দিকে ধাবিত হলে, তাতে কেউই বিজয়ী হবে না।
আপনার মতামত জানানঃ