
চীন নির্মাণ করতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ বাঁধ, যার সম্ভাব্য প্রভাব শুধু পরিবেশগত নয়, বরং সামগ্রিকভাবে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিক কাঠামোকে নাড়িয়ে দিতে পারে। সম্প্রতি চীন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে যে তারা ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণের কাজে নেমেছে, যদিও স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রকল্পটির কাজ ২০২১ সালেই শুরু হয়ে গেছে। হিমালয়ের তিব্বত অংশে, ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের মাঝখানে স্থাপিত এই বাঁধটি সম্পূর্ণ হলে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে চীনের নিজস্ব থ্রি গর্জেস বাঁধকেও ছাড়িয়ে যাবে।
নদীর প্রবল অবতরণশীল ধারা কাজে লাগিয়ে তিনগুণ বেশি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা থাকলেও, প্রকল্পটির গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কারণ, এটি কেবল একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নয়; এটি চীনের কৌশলগত আধিপত্য বিস্তারের একটি শক্তিশালী অস্ত্রও বটে। ব্রহ্মপুত্র নদ ভারতের অরুণাচল ও আসাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। ফলে এই নদীতে চীনের একতরফা বাঁধ নির্মাণ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক বিপদের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বাঁধের মাধ্যমে চীন মৌসুমি বন্যার স্বাভাবিকতা ব্যাহত করবে, নদীর পলি আটকে রেখে বাংলাদেশের কৃষিজমি, মৎস্যসম্পদ এবং ব-দ্বীপ অঞ্চলের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলবে। উল্লেখ্য, পলি নদীর প্রাকৃতিক উপাদান যা উপকূলীয় অঞ্চলে জমি সৃষ্টি করে এবং কৃষিজমিকে উর্বর রাখে। এই পলি আটকে দিলে বাংলাদেশের ব-দ্বীপ অঞ্চলে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ বাড়বে এবং ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকিও বহুগুণে বাড়বে।
এছাড়াও, বাঁধটি একটি সক্রিয় ভূ-ভাগীয় ফল্ট লাইনের ওপর নির্মিত হচ্ছে। গবেষণা বলছে, এমন বড় বাঁধ ভূমিকম্পকে উৎসাহিত করতে পারে। যাকে বলা হয় রিসার্ভয়ার ট্রিগারড সিসমিকসিটি। বাঁধের পানির চাপে টেকটোনিক প্লেটগুলোর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটার আশঙ্কা থাকে। হিমালয়ের মতো ভূকম্পনপ্রবণ এলাকায় এত বড় জলাধার একটি স্থায়ী বিপদের নামান্তর।
এই বাঁধের আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো রাজনৈতিক। চীন এমন এক স্থানে বাঁধ তৈরি করছে যেখানে ভারতের সাথে তার সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। তিব্বতের এই অংশকে চীন ‘দক্ষিণ তিব্বত’ বলে দাবী করে যা আসলে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ। ২০২০ সালে এই অঞ্চলেই ভারত-চীন সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ ঘটেছিল। নতুন বাঁধ নির্মাণ সেই উত্তেজনারই পুনরাবৃত্তির ইঙ্গিত দেয়। একবার যদি ভারত-চীন সম্পর্ক আবারও উত্তপ্ত হয়, চীন তার উজানের এই বাঁধ ব্যবহার করে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে কৌশলগত চাপ প্রয়োগ করতে পারে।
জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এর কৌশলগত দিক। চীনের থ্রি গর্জেস বাঁধের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যে একটি বড় বাঁধ কিভাবে পরিবেশগত ও মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সে বাঁধ পানির গুণগত মান নষ্ট করেছে, নদীতীর ক্ষয় করেছে, ভূমিধস সৃষ্টি করেছে এবং বন্যার প্রবণতা বাড়িয়েছে। অথচ, আন্তর্জাতিকভাবে ব্রহ্মপুত্রের সুপার-ড্যাম নিয়ে এখনো বড় কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না।
ভারত সীমিত উদ্বেগ জানালেও, চীনের মতো শক্তিশালী উজান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার কূটনৈতিক কিংবা আইনি শক্তি খুবই দুর্বল। ভারতের সামনে এখন একমাত্র পথ হলো আন্তর্জাতিকভাবে তিব্বতের ‘ওয়াটার টাওয়ার’ হিসেবে মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য বাধ্যতামূলক নীতিমালার নেতৃত্ব দেয়া। কারণ, চীন এখনো পর্যন্ত কোনো প্রতিবেশী দেশের সাথে নদী-সম্পর্কিত বাধ্যতামূলক চুক্তিতে সই করেনি।
চীনের এই একতরফাবাদী পানি-নীতি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, নেপাল, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড—সব ভাটির দেশের জন্যই একটি স্থায়ী উদ্বেগের কারণ। কারণ, নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে চীন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখতে চায়। বিশেষত বাংলাদেশ, যার পুরো অর্থনীতি ও বাস্তুতন্ত্র এই নদীভিত্তিক।
এই বাঁধ পরিবেশ, সমাজ এবং ভূরাজনীতির এক জটিল সমীকরণ। নদীর প্রবাহ, পলি, মাছ, চাষাবাদ, বন্যা, পানি সরবরাহ, বাস্তুতন্ত্র—সবই একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। আর একটিমাত্র বাঁধ সেই পুরো প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে ভেঙে দিতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, চীনের ব্রহ্মপুত্র সুপার-ড্যাম শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত প্রকল্প নয়। এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র, যা ভবিষ্যতের পানির জন্য লড়াইয়ে চীনকে এককভাবে শক্তিশালী করে তুলবে। বিশ্ব যখন তেল ও গ্যাস ছাড়িয়ে পানিকে ভবিষ্যতের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে দেখছে, চীন এখনই সেই সম্পদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর দক্ষিণ এশিয়ার ভাটির দেশগুলো—বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশ—এক অনিশ্চিত জলযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।
আপনার মতামত জানানঃ