মানুষের দীর্ঘায়ু ও অমরত্বের প্রশ্নটি আদিকাল থেকেই মানবজাতিকে কৌতূহলী করে তুলেছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে সেই কৌতূহল আরও নতুন মাত্রা পেয়েছে। সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আলাপে উঠে এসেছিল অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং ১৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনার কথা। এটি যদিও কিছুটা হাস্যরসাত্মক মন্তব্য ছিল, তবুও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে বাস্তব প্রশ্ন—মানুষ কি একদিন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে আয়ু এত দীর্ঘ করতে পারবে?
অঙ্গ প্রতিস্থাপন আজ চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক বড় সাফল্য। বহু বছর ধরে রোগীরা নতুন কিডনি, লিভার, হার্ট কিংবা ফুসফুস প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দ্বিতীয় জীবন পেয়েছেন। গবেষণা বলছে, জীবিত দাতার কিডনি প্রতিস্থাপিত হলে তা প্রায় দুই দশক থেকে আড়াই দশক পর্যন্ত কার্যকর থাকতে পারে। মৃত দাতার অঙ্গ হলে আয়ু তুলনামূলক কম হয়। লিভার প্রায় ২০ বছর, হার্ট ১৫ বছর এবং ফুসফুস ১০ বছর পর্যন্ত কাজ করে। তবে এ সময়সীমা নির্ভর করে রোগীর শারীরিক স্বাস্থ্য, পরবর্তী যত্ন ও জীবনযাপনের ওপর। অর্থাৎ প্রতিস্থাপন জীবন বাঁচায়, কিন্তু তা সীমাহীন নয়।
প্রতিস্থাপনের অন্যতম বড় সমস্যা হলো অঙ্গ প্রত্যাখ্যান। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাইরের কোনো অঙ্গকে শত্রু হিসেবে ধরে নিয়ে আক্রমণ করে বসে। এজন্য প্রতিটি রোগীকে আজীবন ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট বা অ্যান্টি-রিজেকশন ওষুধ সেবন করতে হয়। এসব ওষুধ শরীরকে সংক্রমণ ও অন্যান্য জটিলতার ঝুঁকিতে ফেলে। একইসঙ্গে উচ্চ রক্তচাপসহ নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ফলে বারবার অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা শুধু চিকিৎসাগতভাবেই নয়, শারীরিক ও মানসিক দিক থেকেও অত্যন্ত কঠিন।
বিজ্ঞানীরা তবে থেমে নেই। তারা এমন অঙ্গ তৈরির চেষ্টা করছেন যা দেহ প্রত্যাখ্যান করবে না। শূকরের জিন পরিবর্তন করে মানবদেহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অঙ্গ তৈরির পরীক্ষা চলছে। সিআরআইএসপিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে শূকরের কিছু জিন সরিয়ে সেখানে মানব জিন বসানো হচ্ছে। এর ফলে প্রতিস্থাপনের পর অঙ্গটি মানবদেহে আরও কার্যকরভাবে টিকে থাকতে পারে। পরীক্ষামূলকভাবে শূকরের কিডনি ও হার্ট মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনও হয়েছে। যদিও এসব রোগী দীর্ঘদিন বাঁচতে পারেননি, তবে এই উদ্যোগ চিকিৎসাবিজ্ঞানে জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন নামে নতুন পথ উন্মোচন করেছে।
স্টেম সেল থেকে অঙ্গ তৈরি করার গবেষণাও সমানভাবে এগোচ্ছে। স্টেম সেলের বিশেষ ক্ষমতা হলো এটি যেকোনো ধরনের কোষে রূপ নিতে পারে। যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা বায়োইঞ্জিনিয়ার্ড স্ক্যাফোল্ড ব্যবহার করে পরীক্ষামূলকভাবে থাইমাস অঙ্গ তৈরি করে ইঁদুরের শরীরে প্রতিস্থাপন করেছেন। একইভাবে লন্ডনের এক হাসপাতালে শিশু রোগীদের অন্ত্রের সমস্যার সমাধানে স্টেম সেল ব্যবহার করে টিস্যু তৈরি করা হয়েছে। যদিও এখনো পূর্ণাঙ্গ মানব অঙ্গ তৈরি সম্ভব হয়নি, তবে অগ্রগতি স্পষ্ট।
অঙ্গ প্রতিস্থাপন ছাড়াও অন্য কিছু পরীক্ষামূলক চিকিৎসা আলোচনায় এসেছে। যেমন প্লাজমা প্রতিস্থাপন। প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ব্রায়ান জনসন নিজের বয়স কমানোর প্রচেষ্টায় ছেলের প্লাজমা শরীরে নিয়েছিলেন। কিন্তু এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়নি। বরং চিকিৎসা নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্ত বাড়তে থাকায় এ প্রচেষ্টা স্থগিত হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, প্লাজমা প্রতিস্থাপন বা অনুরূপ পদ্ধতি জীবনকাল বাড়াতে পারবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।
তাহলে মানুষের সর্বোচ্চ আয়ু কত হতে পারে? বৈজ্ঞানিকরা বলছেন, মানবজীবনের সর্বোচ্চ সীমা প্রায় ১২৫ বছর। ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে বেঁচে থাকা নারী জেনি ক্যালমেন্ট ১২২ বছর জীবিত ছিলেন। তার জীবনই প্রমাণ করে যে এর বাইরে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহ দুর্বল হয়, সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে, ক্ষত সারতে দেরি হয়। ফলে ১৫০ বছর আয়ু পাওয়ার স্বপ্ন এখনো বাস্তবসম্মত নয়।
অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দীর্ঘায়ু অর্জন নিঃসন্দেহে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক আকর্ষণীয় ভাবনা। তবে প্রতিস্থাপনের ঝুঁকি, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, এবং দেহের প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা এই স্বপ্নকে এখনো বাস্তব থেকে দূরে রাখছে। গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হলো অসুস্থতা নিরাময় করা, অমরত্ব প্রদান নয়। তাই চিকিৎসকেরা জোর দিচ্ছেন, আয়ু বাড়ানোর চেয়ে সুস্থ জীবন কাটানোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের বিজ্ঞান আমাদের শিখিয়েছে, অঙ্গ প্রতিস্থাপন জীবন বাঁচাতে পারে, কিন্তু অমরত্ব দিতে পারে না। হয়তো ভবিষ্যতে প্রযুক্তির উন্নতি আমাদের অনেকদূর এগিয়ে নেবে, কিন্তু বর্তমানে মানুষের জন্য প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত স্বাস্থ্যকর ও গুণগত জীবনযাপন। দীর্ঘায়ু নয়, বরং সুস্থভাবে বাঁচাটাই মানবজাতির সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।
আপনার মতামত জানানঃ