
চীনের কাছ থেকে ধার ও বিনিয়োগের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় এখন গুরুতর ঝুঁকিতে রয়েছে ব্রিটেন। দেশটির অর্থনীতি, রাজনীতি ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই চীনের প্রভাব ক্রমেই বেড়ে চলেছে বলে উদ্বেগ জানাচ্ছেন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিকরা। তাদের আশঙ্কা, এই নির্ভরশীলতা একসময় চীনের হাতে ব্রিটেনকে জিম্মি করে ফেলতে পারে। ব্রিটেনের শত শত বিলিয়ন পাউন্ড ঋণ এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে, যার একটি বড় অংশ চীনের কাছে। ফলে অনেকেই বলছেন, ব্রিটেন হয়তো শিগগিরই চীনের ‘ঋণের ফাঁদে’ পড়তে পারে—যেমনটি আগে শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে ঘটেছিল। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারকে সতর্ক করেছেন দেশটির নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
এই সতর্কতা এমন এক সময়ে এসেছে, যখন লেবার সরকার সম্প্রতি চীনের দুই সন্দেহভাজন গুপ্তচরের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে যে, তারা বেইজিংয়ের চাপের মুখে নতি স্বীকার করেছে। সাবেক নিরাপত্তা মন্ত্রী টম টুগেনডাট বলেছেন, সরকার জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে দুর্বলতা দেখিয়েছে এবং চীনের কাছে মাথানত করেছে। অপর এমপি অ্যালিসিয়া কেয়ার্নস প্রশ্ন তুলেছেন—চীনকে ‘নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে ঘোষণা না করার সিদ্ধান্ত কে নিয়েছে এবং কেন।
প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোনাথন পাওয়েল এই মামলার বিষয়ে সরাসরি পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে লেবার সরকার স্বীকার করেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা সরকারের অবস্থান নিয়ে আরও প্রশ্ন তুলেছে। কনজারভেটিভ নেতা কেমি ব্যাডেনক প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে অভিযোগ করেছেন, স্টারমার সরকার চীনকে তুষ্ট করতে গিয়ে ব্রিটেনের নিরাপত্তা দুর্বল করে ফেলেছে। তার দাবি, এই ঘটনায় সরকার চারটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছে, যা বিভ্রান্তিকর ও অস্পষ্ট।
ব্রিটেনের মোট জাতীয় ঋণ এখন প্রায় তিন ট্রিলিয়ন পাউন্ড। এর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—চীনের হাতে ঠিক কত ঋণ আছে তা জানা যায় না, কারণ ট্রেজারি এ বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবে চীনের হাতে থাকা আমেরিকান বন্ডের হিসাব প্রকাশ করে, যেখানে দেখা গেছে ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য বিরোধের পর চীন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ব্রিটেনের ক্ষেত্রে বিষয়টি রহস্যে ঘেরা।
লন্ডনের সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, ব্রিটিশ ট্রেজারি সম্প্রতি চীনের গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে একটি সরকারি প্রতিবেদন প্রকাশ ঠেকাতে লবিং করেছে। এতে ধারণা জোরালো হয়েছে যে, সরকার চীনের আর্থিক প্রভাব নিয়ে খুবই সতর্ক, এমনকি অনেক সময় বেইজিংকে বিরক্ত না করার নীতিও অনুসরণ করছে। বিশ্লেষক এডওয়ার্ড ইয়ারডেনি বলেছেন, ব্রিটেনের বন্ডের বড় অংশ চীনের হাতে থাকলে বেইজিং সেটিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। অর্থাৎ, তারা ব্রিটেনকে জানাতে পারে কোন নীতিতে তারা সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট।
ইয়ারডেনি মনে করেন, চীন অতীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়ে তাদের কৌশলগত সম্পদে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণ হলো শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর, যা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত চীনের হাতে লিজে দিতে হয়েছিল। তার মতে, একটি দেশ যখন অতিরিক্ত ঋণে জর্জরিত থাকে, তখন সেটি সহজেই অন্য দেশের প্রভাবের শিকার হতে পারে। ব্রিটেনের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা এমন এক পর্যায়ে যে, তারা হয়তো নিজের স্বার্থের বদলে চীনের মনোভাব বিবেচনা করছে।
লেবার সরকারের অর্থমন্ত্রী র্যাচেল রিভস চীনা বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী। তার ‘গ্রোথ মিশন’ নীতির অংশ হিসেবে চীনকে যুক্তরাজ্যে নতুন বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ব্রিটেনে চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ দাঁড়ায় প্রায় ৩.৭ বিলিয়ন পাউন্ড। যদিও কনজারভেটিভ আমলে এই বিনিয়োগ কমেছিল, এখন তা আবার বেড়ে চলেছে। কিন্তু সম্প্রতি চীন ঘোষণা দিয়েছে, কোনো দেশ যদি চীনা খনিজ বা ব্যাটারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করতে চায়, তাহলে বেইজিংয়ের অনুমতি নিতে হবে। এই ঘোষণা ব্রিটেনের জন্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে, কারণ দেশটির নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ইলেকট্রিক যানবাহন শিল্পে চীনা প্রযুক্তি ও কাঁচামালের ওপর নির্ভরতা অনেক বেশি।
ইন্টার-পার্লামেন্টারি অ্যালায়েন্স অন চায়নার প্রধান লিউক ডি পুলফোর্ড বলেছেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এখন স্পষ্টভাবে অন্য দেশের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এমপি অ্যালিসিয়া কেয়ার্নস সতর্ক করে বলেছেন, যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে ব্রিটেন একসময় চীনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, এবং একপ্রকার চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই চলতে হবে।
ব্রিটেনের ঋণের সুদের হার সম্প্রতি ২৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে এবং বাজেট ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের এই আর্থিক দুর্বলতা সরকারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, তারা বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে ভয় পাচ্ছে। ২০১৯ সালে ইউবিএস ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ পল ডোনোভান চীনের ‘শূকর জ্বর’ নিয়ে মন্তব্য করায় চাকরি হারান—যা থেকে বোঝা যায়, ব্রিটিশ আর্থিক খাত এখন চীনকে সমালোচনা করতে ভয় পায়।
চীনা কোম্পানি মিং ইয়াং সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, তারা স্কটল্যান্ডে ১.৫ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় উইন্ড টারবাইন কারখানা গড়বে। এটি সরকারে জ্বালানি মন্ত্রী এড মিলিব্যান্ডের জন্য বড় অর্জন হিসেবে দেখা হলেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সতর্ক করেছে, এই প্রকল্পগুলো গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। চীনা প্রকৌশলীদের মাধ্যমে সংবেদনশীল তথ্য চুরি বা নজরদারির আশঙ্কাও রয়েছে। দ্য টেলিগ্রাফ-এর তথ্যমতে, চীনা বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে ব্রিটেনের বড় বড় পাবলিক কোম্পানিতে প্রায় ৯০ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও তাদের সার্বভৌম তহবিল এখন বিএই সিস্টেমস, রোলস-রয়সে ও ব্যাবককের মতো প্রতিরক্ষা সংস্থার শেয়ারহোল্ডার।
এই অবস্থায় সরকার চীনের প্রতি নরম অবস্থান নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গুপ্তচরবৃত্তির মামলা প্রত্যাহারের পেছনে ট্রেজারি বিভাগের ভূমিকাও এখন তদন্তাধীন। অভিযোগ করা হচ্ছে, ট্রেজারি ও জোনাথন পাওয়েল যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে চীন ক্ষুব্ধ হয়ে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বন্ধ না করে।
এই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা বলেছে, ব্রিটেন তার জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে অদূরদর্শিতা দেখাচ্ছে। হোয়াইট হাউসও সতর্ক করেছে—লন্ডনে পরিকল্পিত চীনা “সুপার-এম্বাসি” নির্মাণের অনুমতি না দিতে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি, বরং ২১ অক্টোবরের সময়সীমা আরও পিছিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ব্রিটেন এক জটিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে পড়েছে। দেশটি এখন অতিরিক্ত ঋণ, ব্যয় এবং অর্থনৈতিক মন্দার চাপে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে চীন—যা কেবল অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক প্রভাবেও রূপ নিচ্ছে। একদিকে সরকার বিনিয়োগ টানতে চাইছে, অন্যদিকে এই বিনিয়োগই দেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই যদি ব্রিটেন ঋণ ও বিনিয়োগের উৎস বৈচিত্র্যময় না করে, তাহলে ভবিষ্যতে চীনের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
চীন এখন শুধু অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগতভাবেও ব্রিটেনের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে। আর ব্রিটেনের নীতিনির্ধারকদের সামনে প্রশ্ন একটাই—তারা কি নিজেদের আর্থিক স্বার্থের কারণে চীনের প্রভাব মেনে নেবেন, নাকি দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় কঠোর অবস্থান নেবেন? সময়ই হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর দেবে।
আপনার মতামত জানানঃ