ব্রিটিশ নাগরিকত্বকে দীর্ঘদিন ধরে ধরা হতো একটি স্থায়ী অধিকার—যা একবার অর্জিত হলে তা আর প্রশ্নের মুখে পড়ে না। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চরিত্রে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, যা এই ধারণাকে ভেঙে দিচ্ছে। নতুন গবেষণা বলছে, ব্রিটেনের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ—যাদের বড় অংশ মুসলিম এবং দক্ষিণ এশীয়, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত—আজ নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। এটি নিছক কোনো আইনি জটিলতা নয়; বরং এটি একটি রাজনৈতিক প্রকল্প, যার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র নাগরিকত্বকে একটি শর্তাধীন সুবিধায় রূপান্তর করছে।
এই ঝুঁকির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকা একটি ‘চরম ও গোপনীয়’ ক্ষমতা—নাগরিকত্ব বাতিলের অধিকার। বর্তমান আইনের অধীনে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি মনে করেন যে কোনো ব্রিটিশ নাগরিক অন্য একটি দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য, তাহলে সেই ব্যক্তির ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করা যেতে পারে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—বাস্তবে ওই ব্যক্তি কখনো সেই দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন কি না, বা সেই দেশে কখনো বসবাস করেছেন কি না—তা বিবেচ্য নয়। যোগ্যতা থাকাই যথেষ্ট। এই আইন কাগজে-কলমে নিরপেক্ষ মনে হলেও বাস্তবে এটি গভীরভাবে বৈষম্যমূলক।
কারণ, যুক্তরাজ্যের অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ নাগরিকের দ্বিতীয় কোনো নাগরিকত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে তাদের নাগরিকত্ব কার্যত অখণ্ড। বিপরীতে, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে পারিবারিক বা জাতিগত সম্পর্ক আছে—এমন মানুষদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ধরে নিচ্ছে, তাদের ‘অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে’। এই ধারণার মধ্য দিয়েই ব্রিটেনে একটি দুই-স্তরীয় নাগরিকত্ব ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে—একটি পূর্ণ ও নিরাপদ নাগরিকত্ব, আরেকটি শর্তাধীন ও অস্থায়ী নাগরিকত্ব।
এই ব্যবস্থার জন্ম হঠাৎ করে হয়নি। এর শিকড় রয়েছে ২০০১ সালের পরবর্তী সময়ের ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজনীতি’তে। নাইন-ইলেভেনের পর যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরা হয়। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বাড়তে থাকে, আর নাগরিক অধিকারের পরিসর সংকুচিত হতে থাকে। নাগরিকত্ব বাতিল—যা একসময় যুদ্ধকালীন চরম পরিস্থিতিতে ব্যবহারযোগ্য একটি ব্যতিক্রমী ক্ষমতা ছিল—তা রূপ নেয় নিয়মিত রাষ্ট্রীয় হাতিয়ারে। ২০১০ সালের পর থেকে ‘জনস্বার্থ’ বা ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র মতো অস্পষ্ট যুক্তি দেখিয়ে দুই শতাধিক মানুষের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই মুসলিম।
এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব আরেকটি বড় সমস্যা। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য সরকার এমন আইন পাস করে, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে না জানিয়ে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ একজন মানুষ হয়তো জানতে পারবেনই না যে তিনি আর ব্রিটিশ নাগরিক নন—যতক্ষণ না তিনি পাসপোর্ট নবায়ন করতে যান, বা ভ্রমণের সময় সীমান্তে আটক হন। নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই নেওয়া হয় গোপন নথি, গোপন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে—যা অভিযুক্ত ব্যক্তি বা তার আইনজীবীও দেখতে পান না। ফলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ কার্যত অনুপস্থিত।
রানীমীড ট্রাস্ট ও রিপ্রিভের গবেষণা দেখাচ্ছে, এই ক্ষমতার প্রভাব অসমভাবে পড়ছে অশ্বেতাঙ্গ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর। প্রতি পাঁচজন অশ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ নাগরিকের মধ্যে তিনজন নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে, যেখানে শ্বেতাঙ্গদের ক্ষেত্রে এই হার প্রতি বিশ জনে মাত্র একজন। এই পরিসংখ্যান কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়; এটি রাষ্ট্রীয় নীতির কাঠামোগত পক্ষপাতের প্রতিফলন। নাগরিকত্ব এখানে আর একটি আইনি মর্যাদা নয়—বরং জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর নির্ভরশীল এক ধরনের শর্তযুক্ত স্বীকৃতি।
এই ব্যবস্থার আরেকটি ভয়াবহ দিক হলো—এটি মুসলিম নাগরিকদের একটি ‘স্থায়ী সন্দেহভাজন’ অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে। নাগরিকত্ব বাতিলের ভয় মানুষের রাজনৈতিক মতপ্রকাশ, প্রতিবাদ, এমনকি দৈনন্দিন জীবনেও প্রভাব ফেলছে। অনেকে মনে করছেন, রাষ্ট্রের চোখে পড়লে বা কোনো ভুল বোঝাবুঝিতে জড়ালে তাদের নাগরিক পরিচয়ই ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ফলে নাগরিকত্ব আর স্বাধীনতার নিশ্চয়তা নয়; বরং এটি হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার।
২০২৫ সালের নতুন আইনি সংশোধনী এই উদ্বেগকে আরও গভীর করেছে। এই আইনের ফলে, আদালত যদি নাগরিকত্ব বাতিলকে বেআইনি বলেও ঘোষণা করে, তবুও সরকারের আপিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তি নাগরিকত্ব ফিরে পাবেন না। এই আপিল প্রক্রিয়া কখনো কখনো বছরের পর বছর চলতে পারে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত একজন মানুষকে দীর্ঘ সময় কার্যত রাষ্ট্রহীন অবস্থায় আটকে রাখতে পারে—যেখানে তিনি কাজ করতে, ভ্রমণ করতে বা মৌলিক অধিকার ভোগ করতে অক্ষম।
এই পরিস্থিতি ব্রিটিশ রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নাগরিকত্ব কি একটি অধিকার, নাকি রাষ্ট্রের দেওয়া শর্তাধীন অনুমতি? যদি রাষ্ট্র ইচ্ছামতো, গোপনে এবং অসমভাবে নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারে, তাহলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে যায়। নাগরিকত্ব তখন আর সবার জন্য সমান থাকে না; বরং তা হয়ে ওঠে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র।
বিশেষ করে বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মুসলিমদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বহুগুণ বেশি। ব্রিটেনে বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীগুলো বহু প্রজন্ম ধরে শ্রম, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অবদান রেখে এসেছে। তবু রাষ্ট্রীয় নীতির চোখে তারা এখনো ‘সম্পূর্ণ ব্রিটিশ’ নন—বরং এমন নাগরিক, যাদের প্রয়োজনে বাদ দেওয়া যেতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ব্রিটেনের বহুসাংস্কৃতিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এই ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকানোর কার্যকর কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই। সংসদীয় নজরদারি সীমিত, বিচারিক প্রক্রিয়া ধীর ও অসম, আর নাগরিক সমাজের আপত্তি উপেক্ষিত। ফলে নাগরিকত্ব বাতিল এখন আর ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়; বরং এটি একটি স্বাভাবিক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে পরিণত হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে—ব্রিটেন কি ধীরে ধীরে একটি এমন রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, যেখানে নাগরিকত্ব আর সমান অধিকার নয়, বরং জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর নির্ভরশীল এক ধরনের শর্তসাপেক্ষ অবস্থান? মুসলিম নাগরিকদের ক্ষেত্রে কি নিরাপত্তার রাজনীতি গণতন্ত্রকে গ্রাস করছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর শুধু যুক্তরাজ্যের জন্য নয়; বরং সারা বিশ্বের অভিবাসী সমাজ ও নাগরিকত্বের ভবিষ্যতের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, আজ যা ব্রিটেনে ঘটছে, তা কাল অন্য কোনো দেশে ঘটতে পারে। নাগরিকত্ব যদি রাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়ে, তাহলে গণতন্ত্র কেবল একটি খোলস হয়ে থাকে। আর সেই খোলসের ভেতরে বসবাস করা মানুষরা—বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা—সবসময়ই ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
আপনার মতামত জানানঃ