ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে রুপি–রুবল আর্থিক ব্যবস্থার উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন ডলারই বৈশ্বিক বাণিজ্য ও লেনদেনের প্রধান মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি, নিষেধাজ্ঞা এবং কঠোর অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে অনেক দেশ ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে ভারতের ওপর চাপ বেড়ে যায়—একদিকে আমেরিকার সাথে বাণিজ্যিক উত্তেজনা, অন্যদিকে রাশিয়া থেকে তেল আমদানির ক্ষেত্রে বারবার সতর্কবার্তা। ফলে ভারত কৌশলগতভাবে রাশিয়ার সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এই প্রক্রিয়ায় রুপি–রুবল লেনদেন কাঠামো একটি বড় ভূমিকা রাখছে। আগে এই ব্যবস্থা সীমিত ছিল মূলত প্রতিরক্ষা ক্রয়-বিক্রয় ও জ্বালানি তেল আমদানি–রপ্তানিতে। এখন সেটিকে আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে শিক্ষা, পর্যটন, আইটি পণ্য, ইলেকট্রনিক্স ও ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে। এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ফি পাঠাতে সহজ বোধ করবে, পর্যটকেরা বিনা ঝামেলায় খরচ চালাতে পারবে এবং ব্যবসায়ীরাও দ্রুত অর্থপ্রদান বা স্থানান্তর করতে পারবে। অর্থাৎ দৈনন্দিন ব্যবহার থেকে শুরু করে বড় বিনিয়োগ—সব ক্ষেত্রেই এই কাঠামো কার্যকর হয়ে উঠবে।
ভারতের রাষ্ট্রদূত বিনয় কুমারের ভাষ্যমতে, উভয় দেশের অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ইন্দো–রাশিয়ান ব্যাংকিং ওয়ার্কিং গ্রুপ বর্তমানে প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক বাধাগুলো দূর করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এই গ্রুপের আলোচনায় শিক্ষার্থী, পেশাদার ও পর্যটকদের লেনদেন সংক্রান্ত সমস্যাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে রাশিয়ার ভিটিবি ও এসবারব্যাংক ভারতে কাজ করছে এবং রাশিয়ান নাগরিকদের ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। ভবিষ্যতের নতুন ব্যবস্থা এই বিদ্যমান পরিষেবার ভিত্তিতেই আরও বিস্তৃত হবে এবং রাশিয়া–ভারতের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় সরাসরি অর্থপ্রদান সম্ভব করবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই উদ্যোগের সবচেয়ে বড় সাফল্য হবে মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা কমানো। বর্তমানে আন্তর্জাতিক লেনদেনে প্রায় ৬০% অংশ মার্কিন ডলারে সম্পন্ন হয়। কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রুবলের ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়েছে। একই সময়ে ভারতও আমদানি–রপ্তানিতে ডলারের চাপ অনুভব করছে। ফলে রুপি–রুবল কাঠামো উভয় দেশকেই আর্থিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্য দেবে এবং ভূরাজনৈতিকভাবে একটি বিকল্প জোট গঠনের পথে এগিয়ে নেবে।
এই পদক্ষেপকে অনেকেই ভারতের “বৃহত্তর কৌশলগত পরিবর্তন” হিসেবে দেখছেন। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে, অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করা—এটি ভারতের দ্বৈত কূটনৈতিক ভারসাম্যের একটি অংশ। শিক্ষা ও পর্যটনের মতো নরম খাতে সহযোগিতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক সম্পর্ককেও গভীর করবে। ফলে ভারত–রাশিয়া সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছাবে।
সবশেষে বলা যায়, রুপি–রুবল আর্থিক ব্যবস্থা কেবল একটি বাণিজ্যিক পদক্ষেপ নয়, বরং এটি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি রাজনৈতিক বার্তাও বয়ে আনছে। এটি দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মার্কিন ডলারের একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থাও কার্যকর হতে পারে। ভারতের জন্য এটি রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ, রাশিয়ার জন্য এটি নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলার হাতিয়ার এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য এটি এক নতুন আর্থিক ভারসাম্যের সূচনা।
আপনার মতামত জানানঃ