সুইডেনের কেরোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ন্যাজাল স্প্রে ভ্যাকসিনের উৎপাদন ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হবে বাংলাদেশে। ইতিমধ্যেই ৩০ কোটি ডোজ বাংলাদেশেই উৎপাদন করার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকও সই করা হয়েছে। খুব দ্রুতই বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) অনুমতি নিয়ে ভ্যাকসিনটির মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ শুরু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশেও।
সম্প্রতিই সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর নতুন এক ভ্যাকসিনের প্রোটোটাইপ উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছে। ডিএনএ ভ্যাকসিন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উদ্ভাবিত নতুন এই ভ্যাকসিনটি দামে কম, উৎপাদন সহজ এবং নিরাপদ বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও উৎপাদন হবে দেশেই
দেশেই আগামী সেপ্টেম্বরেই শুরু হতে পারে এই ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম পর্ব। এরপর ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বও বাংলাদেশে শুরু করা হবে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষে সন্তোষজনক ফলাফল নিয়ে এটি বাংলাদেশেই উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা। এতে করে শুধুমাত্র দেশের মানুষদের উপরেই প্রয়োগ নয়, বরং উৎপাদন করে বিদেশেও ভ্যাকসিন রফতানি করতে পারে বাংলাদেশ।
সম্প্রতি কেরোলিনস্কা ইনস্টিউটের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে এই কাজে সহায়তা করেন প্রবাসী বাংলাদেশীরাও। ভ্যাকসিনটি বাংলাদেশে এনে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও উৎপাদনের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে একটি বিশেষজ্ঞ দল, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডা. আরিফুর রহমান। দেশে ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও উৎপাদনবিষয়ক কাজের সমন্বয়ের জন্য গত ১৫ দিন সুইডেনে অবস্থান করছেন ডা. আরিফুর। এছাড়া এই টিমের সঙ্গেই বাংলাদেশ থেকে সহায়তা করছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ, অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘সুইডেনের কেরোলিনস্কা ইনস্টিউটের যে ভ্যাকসিনটি আছে সেটির প্রাথমিক ফলাফল খুবই ভালো। এটা মূলত একটি ন্যাজাল স্প্রে ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিন নাক ও মুখের মধ্য দিয়ে পাউডারের মত স্প্রে করে দেওয়া যাবে। এর জন্য কোনো আলাদা স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজন হবে না। যে কেউ চাইলে নিজেই ভ্যাকসিনটি নিতে পারবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই ভ্যাকসিনটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি যেকোনো তাপমাত্রায় রাখা যায়। তাই দেশ-বিদেশের সব জায়গায় সহজেই পাঠানো যাবে। আমরা যদি এই ভ্যাকসিনটির সবকিছু চূড়ান্ত করে আনতে পারি তবে খুব দ্রুতই উৎপাদনেও যেতে পারব। আর তখন দেশের মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি আমরা বিদেশেও রফতানি করতে পারব।’
ডা. আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরাই যদি ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করি তখন কিন্তু আমাদের দেশের দরিদ্র গোষ্ঠীর মানুষকে স্বল্পমূল্যে কিংবা সরকার চাইলে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথাও ভাবতে পারবো। একই সঙ্গে আমরা যখন রফতানি করব, তখন সেটাও আমাদের দেশের প্রাপ্তির খাতাতেই যোগ হবে।’
মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিন’র সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা ভ্যাকসিনটি নিয়ে খুবই আশাবাদী। কারণ এর অ্যানিম্যাল ট্রায়ালের ফলাফল খুবই ভালো। আমরা প্রাথমিকভাবে এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চেষ্টা করছি। ফেজ-১ যদি আমরা শুরু করতে পারি তবে সেটি নভেম্বরের মধ্যেই শেষ করা যাবে। এরপরে আমরা ফেজ-২ ও ফেজ-৩ মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু অ্যানিম্যাল ট্রায়ালের ফলাফল খুবই ভালো তাই আশা করছি এই ভ্যাকসিনটি আমাদের দেশেও কার্যকর হবে। আর এই ভ্যাকসিন আমরা উৎপাদন শুরু করতে পারলে এটি আমাদের আরেকটি বিশাল সফলতা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিনটির প্রথম পর্বের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এটি সেপ্টেম্বরে শুরু করা গেলে খুব দ্রুতই ফলাফল পাওয়া যাবে। পরবর্তী সময়ে আমরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ফেজের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করব।’
প্রাথমিক গবেষণায় ফলাফল
চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যাকসিনটির অ্যানিম্যাল ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করা হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ন্যাচার জার্নালে। এই জার্নালটিতে প্রকাশক হিসেবে আছেন ইঙ্গা জারগট, লিও হ্যাঙ্ক, ডানিয়েল যে শেউয়ার্ড, লরা পেরেজ, বেন মুরেল, জেরার্ড এম ম্যাকলার্নি, পিটার লিজেস্ট্রম। মূলত এই ভ্যাকসিনটি পিটার লিলেস্ট্রম ল্যাবের ড. ইঙ্গা জারগট ও ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের জেরাল্ড ম্যাকলার্নির প্রচেষ্টায় শুরু করা হয়।
জার্নালে প্রকাশিত ফলাফলে জানানো হয়েছে, ইঁদুরের ওপর চালানো গবেষণা থেকে গবেষকরা দেখেছেন, এই ভ্যাকসিন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সক্ষম। প্রাথমিকভাবে ডিআরইপি-এস নামকরণকৃত এই ভ্যাকসিন গ্রহীতার শরীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আরএনএ রিপ্লেকেশন শুরু করবে এবং নিজে থেকেই আরএনএ উৎপাদন বাড়াবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ডিআরইপি-এস ভ্যাকসিনটি ইঁদুরের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম। বিশেষ করে, এক ডোজ নেওয়ার পরই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন গ্রহীতার দেহে শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
এ ব্যাপারে গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, এই ভ্যাকসিনের আলাদা দুইটি ডোজ শরীরে আলাদা ধরনের প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই ভ্যাকসিন পরিবহন এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নিম্ন তাপমাত্রা রক্ষা করতে হবে না।
এছাড়াও, ভাইরাসের নিত্য নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এই ভ্যাকসিন দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। মূলত একটি আরএনএ সিকোয়েন্সেরই কয়েকটি কপি তৈরি করতে থাকবে, এমনটাই জানিয়েছেন গবেষকরা।
সূত্র মতে, উদ্ভাবন প্রক্রিয়ায় থাকা এই ভ্যাকসিনটি যেহেতু নিজ থেকেই আরএনএ রিফ্লেকশনের কাজ করতে থাকবে, তাই এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম ডোজই কার্যকর হবে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হবে সামান্য বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
এর আগে, ডিএনএ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উদ্ভাবিত এইচআইভি, ইবোলা, চিকনগুনিয়া এবং এইচপিভির ভ্যাকসিনও উদ্ভাবন করা হয়েছে। যা এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সুইডেনের এই ভ্যাকসিনটি রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট লিস্টেও। কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে শরীরে দ্রুত অ্যান্টিবডি তৈরির ব্যবস্থা করা যাবে— এমন ভাবনা থেকে ন্যাজাল স্প্রে ভ্যাকসিন তৈরি কাজ শুরু হয়। এটি প্রতিষেধকের বিকল্প হিসেবেই ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে একটি হাইব্রিড অ্যান্টিবডি তৈরি করা হয়। এই হাইব্রিড অ্যান্টিবডি ইঁদুরের শরীরে গেলে ফুসফুসে করোনার সংক্রমণ সারাতে সক্ষম বলেই জানানো হয়েছে ন্যাচারে প্রকাশিত জার্নালে। শুধুমাত্র সুইডেনই নয়, ভারত বায়োটেকসহ বিশ্বের আরও বেশকিছু দেশে এই ন্যাজাল স্প্রে ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭২৫
আপনার মতামত জানানঃ