জাতীয় বাজেট, সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য খাতের উপেক্ষিত হবার ঘটনা নতুন নয়। এছাড়া বাজেট স্বল্পতা, অব্যবস্থাপনা, দুর্বল অবকাঠামো, জনবলের ঘাটতি, অদক্ষতা, দুর্নীতির কারণে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা একপ্রকার বিধ্বস্ত। রোগীদের থেকেও জীর্ণ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় জানা গেছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী টিকা সংশ্লিষ্টতার যে কথা বলেছেন, বাস্তবে তার অর্ধেকেরও কম হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। কিন্তু টিকায় ১৪ হাজার থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। একইসাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর টিকা পাওয়ার অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে
মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) ‘করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসন : অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
অনলাইন প্লাটফর্মে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক মো. জুলকারনাইন ও কাওসার আহমেদ।
গবেষণায় ৪৩টি জেলায় ১০৫টি টিকা কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে। যার মধ্যে ৬০টি অস্থায়ী এবং ৪৫টি স্থায়ী টিকা কেন্দ্র ছিল। এছাড়া ৪৮টি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ৬৭১ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
টিআইবি বলছে, যারা সরকারি পরীক্ষাগারে নমুনা দিতে গিয়েছে তাদের ১৪.৯ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে নির্ধারিত ফি অপেক্ষা গড়ে ১১৬ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়েছে। যারা বাড়ি থেকে নমুনা দিয়েছে তাদের গড়ে ৬৪২ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়েছে এবং বেসরকারি হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে গড়ে ৪ হাজার ৪২৫ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি পরীক্ষাগারে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে অন্য পরীক্ষা করতে বাধ্য করা হয়েছে। যথাসময়ে বা দ্রুত প্রতিবেদন পেতে ৪.৪ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে গড়ে ১৩৩ টাকা নিয়ম-বহির্ভূতভাবে অর্থ দিতে হয়েছে। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় নেগেটিভ সার্টিফিকেট পেতে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে বিদেশ থেকে প্রত্যাগতদের গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিতে হয়েছে।
এদিকে হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণকারীদের ২২.২ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ধরনের মধ্যে সেবা দিতে সময়ক্ষেপণ, কোভিড ইউনিটে স্বাস্থ্যকর্মীদের অনুপস্থিতি বা দায়িত্ব পালনে অবহেলা, দুর্ব্যবহার বা অসহযোগিতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আর সরকারি হাসপাতাল থেকে কোভিড-১৯ সেবা গ্রহণের সময় ১২.২ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে ৪০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ম-বহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়েছে।
হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণকারীদের ২২.২ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত ষাট বা তদূর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ লাখ মানুষ টিকার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন (প্রায় ২৯ শতাংশ)। অথচ শেষ ধাপে টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে, যাদের মৃত্যুহার ১ শতাংশের চেয়েও কম। এছাড়া জাতীয় টিকা পরিকল্পনায় দুর্গম এলাকা, ভাসমান মানুষ, বস্তিবাসী, বয়স্ক ব্যক্তি ইত্যাদি জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিতকরণ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেজিস্ট্রেশন ও ভ্রাম্যমাণ টিকা দলের মাধ্যমে টিকা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার কথা বলা হলেও দু’একটি এলাকা ছাড়া এসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।
টিকাগ্রহীতাদের উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রচার কার্যক্রমে ঘাটতি থাকার কারণে ৪৬ শতাংশ মানুষ টিকা নিতে দ্বিধায় ছিলেন। মানুষের মধ্যে টিকা সম্পর্কিত ভুল ধারণা ও ভীতি থাকলেও তা দূর করতে প্রচারের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা নিয়ে সরকারি উদ্যোগের ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। ৭৪.৯ শতাংশ মানুষ পরিবার-আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে টিকার বিষয়ে জেনেছে। সরকারি উদ্যোগে সংগঠিত মাইকিং থেকে টিকা বিষয়ে জেনেছে ৩৩.৮ শতাংশ মানুষ এবং টেলিভিশন থেকে জেনেছে ৪৯.৯ শতাংশ মানুষ।
টিআইবির গবেষণায় টিকা কার্যক্রমে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতার ঘাটতি পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায় টিকা প্রতি ব্যয় ৩ হাজার টাকা। চলতি বছরের ১০ মার্চ টিকা কার্যক্রমে মোট ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিন্তু সরকারি পরিকল্পনায় টিকা কার্যক্রম সম্পর্কিত টিকা প্রতি ব্যয় ২ ডলার বা ১৭০ টাকা ধরা হয়েছিল। এর সঙ্গে ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য ব্যয় যোগ করলে টিকা প্রতি ব্যয় ২৪৪ টাকা ৪০ পয়সা দাঁড়ায়। সে হিসেবে টিকা ক্রয় এবং ব্যবস্থাপনাসহ মোট দাঁড়ায় ১২ হাজার ৯৩ কোটি টাকা থেকে ১৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা, যা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেওয়া হিসেবে অর্ধেকেরও কম।
ঘাটতি পাওয়া গেছে করোনাভাইরাস এর অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়নেও। খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে করোনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। করোনাভাইরাসের প্রভাবে ২৫-৩০ শতাংশ উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে। মোট শিল্পখাতের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা হলেও এ খাতের জন্য বরাদ্দ প্রণোদনা পর্যাপ্ত নয়। ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও এই খাত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
গবেষণাপত্র উপস্থাপন অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থা ও টিকা কার্যক্রম এবং করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নেওয়া প্রণোদনা কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সুশাসনের চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রয়েছে। করোনা সংকট মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ, সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সাড়া দেওয়া এবং সেবা সম্প্রসারণ করা হয়নি। যা বারবার সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মৃত্যুসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্ভোগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।
এর আগে নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ তাদের ২০২০–২১ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, মহামারির শুরুতে ভুল তথ্য, গুজব, অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা সংবাদ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। চিকিৎসাসামগ্রী সংগ্রহ ও রোগনির্ণয়ে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো ছিল বিতর্কিত। রোগীর জন্য জিনিসপত্র সংগ্রহ, নমুনা পরীক্ষার কিট কেনা, কোভিড–১৯ হাসপাতাল স্থাপন থেকে শুরু করে সাধারণ ওষুধ কেনা পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে ছিল দুর্নীতি।
সংস্থাটি বলেছে, স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের না দিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের হাতে দেওয়া হয়েছে।এতে করে কোভিডে আক্রান্তরা সমাজ থেকে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। জেলা প্রশাসকদের এখানে সকল কাজের কাজী বানাতে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছিল না। ফলে পরিকল্পনা হয়েছে এক, মাঠ পর্যায়ে বাস্তবে হয়েছে আরেক। হাসপাতালগুলোতে ইনফেকশন প্রতিরোধী ব্যবস্থা ছিল না। ফলে ডেল্টার সময়ে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ