বাংলাদেশে রপ্তানি ও বিনিয়োগকারী দেশগুলোর ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণে আমাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উদ্বেগজনকভাবে দুর্নীতির ঝুঁকিতে পড়ছে, যা গভীর হতাশার। পরিহাসের বিষয় হলো, এই দেশগুলোর অধিকাংশই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও বিশ্বাসযোগ্য বেশিরভাগ দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে।
বিদেশে ঘুষ লেনদেনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য সহযোগীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর অব্যাহত ও হতাশাজনক ব্যর্থতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
বৃহস্পতিবার সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন,দেশগুলো যা প্রচার করে, তার চর্চা করার জন্য আমরা আহ্বান জানাই। পাশাপাশি দেশগুলোর আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার জন্য যেন যথেষ্ট শক্তিশালী ও কার্যকর হয়, তা নিশ্চিত করতেও আহ্বান জানাই। আমরা আশা করব, তারা আমাদের মতো দেশে তাদের দুর্নীতি রপ্তানি বন্ধে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সবকিছু করবে।
বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) সচিবালয় কর্তৃক ১১ অক্টোবর প্রকাশিত ‘দুর্নীতির রপ্তানি ২০২২ : ওইসিডি ঘুষবিরোধী কনভেনশন প্রয়োগের মূল্যায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনের উল্লেখ করে, খেলাপি দেশগুলোকে তাদের প্রাসঙ্গিক আইনের দুর্বলতা দূরীকরণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।
দ্বিবার্ষিক এই প্রতিবেদনে ৪৭টি শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক রপ্তানিকারক দেশের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৪৩টি ওইসিডি ঘুষবিরোধী কনভেনশনের সদস্য এবং অন্য চারটি শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ হলো চীন, ভারত, হংকং ও সিঙ্গাপুর।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিদেশে ঘুষ দেওয়া বন্ধে ব্যর্থ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশীদার হলো ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং ও সিঙ্গাপুর। বিষয়টিকে বাংলাদেশের জন্য বিপদসংকেত হিসেবে বিবেচনা করা অপরিহার্য।
তিনি বলেন, টিআইবি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশীদারদের ব্যর্থতার কাছে আমাদের জিম্মি হয়ে থাকার যৌক্তিকতা নেই। আমরা আমাদের সরকারকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুর্নীতিনির্ভর সব প্রকার লেনদেন প্রতিরোধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাই।
প্রতিবেদনে শুধুমাত্র সুইজারল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘অ্যাকটিভ এনফোর্সার্স’ হিসেবে বিবেচিত, যদিও তারা সর্বোচ্চ প্রত্যাশিত মান অর্জন থেকে এখনও দূরে রয়েছে। মূল্যায়নে সর্বনিম্ন কার্যকর দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, চেক-প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, আয়ারল্যান্ড, লিথুনিয়া, লুক্সেমবার্গ, মেক্সিকো, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও তুরস্ক।
‘লিমিটেড এনফোর্সার্স’ বা নিচ থেকে দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে— আর্জেন্টিনা, অস্ট্রিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, গ্রিস, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন ও সুইডেন। ‘মডারেট এনফোর্সার্স’ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে— অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, নরওয়ে ও যুক্তরাজ্য।
ঘুষ সূচকে বাংলাদেশের অবনতি
বিশ্ব ঘুষ সূচকে আরও এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ঘুষবিরোধী ব্যবসায়িক সংগঠন ট্রেস প্রকাশিত ২০২১ সালের ঘুষ লেনদেনের ঝুঁকি তালিকায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।
যেসব দেশে ঘুষের ঝুঁকি বেশি, তালিকায় সেসব দেশের পয়েন্টও বেশি। এই তালিকায় ২০২০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৬। ২০২১ সালে ৬৫ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ এক ধাপ পিছিয়ে ১৬৭ নম্বরে চলে এসেছে।
বিশ্বের ১৯৪টি দেশে ঘুষ লেনদেন পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবছর জরিপ চালায় ট্রেস। যেসব দেশে ঘুষের ঝুঁকি বেশি, তালিকায় সেসব দেশের পয়েন্টও বেশি। এই তালিকায় ২০২০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৬। ২০২১ সালে ৬৫ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ এক ধাপ পিছিয়ে ১৬৭ নম্বরে চলে এসেছে।
প্রত্যেক দেশের ঘুষের ঝুঁকি পরিমাপ করা হয়েছে চারটি ক্ষেত্র বিবেচনায়। এগুলো হচ্ছে, সরকারের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক, ঘুষ প্রতিরোধ ও আইনপ্রয়োগ, সরকার ও সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা এবং সুশীল সমাজের নজরদারির ক্ষমতা।
পয়েন্ট বিন্যাস অনুযায়ী, সরকারের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক সূচকে বাংলাদেশে পেয়েছে ৭১ পয়েন্ট, ঘুষ প্রতিরোধ ও আইনপ্রয়োগে ৬৫ পয়েন্ট, সরকার ও সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতায় ৫৯ পয়েন্ট এবং সুশীল সমাজের নজরদারির সক্ষমতার ক্ষেত্রে ৬১ পয়েন্ট।
জরিপ অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ঘুষ লেনদেন হয় উত্তর কোরিয়ায়। এরপরে রয়েছে তুর্কেমেনিস্তান, ইরিত্রিয়া, ভেনেজুয়েলা ও সোমালিয়া। আর সবচেয়ে কম ঘুষ লেনদেন হয় ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও নিউ জিল্যান্ডে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৪
আপনার মতামত জানানঃ