করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশে টিকাদান কার্যক্রমের এক বছর পূর্তি হলো। এই এক বছরে দেশের ৫৭ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। তবু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। করোনা রুখতে বৈশ্বিক টিকাদান পর্যবেক্ষণ ওয়েসবাইট ‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা’-এর তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্র উঠে এসেছে।
ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও মালদ্বীপের চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। কেবল পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মিয়ানমার টিকাদানে বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে।
কতটা পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ
‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা’ ওয়েবসাইটের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৫৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছে।
এই হার ভারতে ৬৮ দশমিক ২০, শ্রীলঙ্কায় ৭৭, পাকিস্তানে ৪৮ দশমিক ০৪, ভুটানে ৮৪ ও মালদ্বীপে ৭৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা নেপালে ৫৬ দশমিক ৭১, মিয়ানমারে ৪০ দশমিক ৩৪ ও আফগানিস্তানে ১১ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে দুই ডোজ করে টিকা পেয়েছেন ৩৬ দশমিক ৯১ শতাংশ মানুষ। এই হার ভারতে ৫২ দশমিক ৩১, পাকিস্তানে ৩৮ দশমিক ৬৩, নেপালে ৪৯ দশমিক ৫৫, শ্রীলঙ্কায় ৬৫ দশমিক ৪৭, ভুটানে ৭৬ দশমিক ৭৮, মালদ্বীপে ৬৮ দশমিক ৫২, মিয়ানমারে ৩৪ দশমিক ৩৯ ও আফগানিস্তানে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ইতিমধ্যে ১০ কোটি ডোজ টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১৫ কোটি ডোজ টিকা দেয়া শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যে জনপ্রতি দুই ডোজ করে মোট সাড়ে সাত কোটি মানুষ টিকা পেয়ে যাবেন। মার্চের মধ্যে সব মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে।
পিছিয়ে থাকার কারণ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকাদানে সঠিক পরিকল্পনা না থাকা, সহজ পথে টিকা সংগ্রহ না করা, টিকা সরবরাহে ঘাটতি, টিকা সংগ্রহে শুরুর দিকে কূটনৈতিক তৎপরতা না থাকা, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর টিকা নিশ্চিত না করে টিকাদানে বয়সসীমা কমানো, ৬ মাস টিকাদান কর্মসূচিতে ধীরগতিসহ নানা কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় টিকাদান কর্মসূচিতে পিছিয়ে আছে দেশ।
সরকার শুরুর দিকে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। সে হিসাবে দেশে টিকা গ্রহণের উপযোগী জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১২ কোটি। তবে গত বছরের ডিসেম্বরে এসে এই লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ কমিয়ে ৭০ শতাংশ করা হয়।
সে লক্ষ্যে ১১ কোটি ৯২ লাখ ২১ হাজার ৯৫৩ জনকে টিকাদানে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কেন ১০ শতাংশ মানুষকে টিকাদানের পরিকল্পনা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে তা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা হয়নি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ২৩ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশে ৭০ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকা দেয়া তাদের লক্ষ্য, আর এই সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে আগামী মার্চের মধ্যেই টিকার আওতায় আনা হবে। সে অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি শেষে ৮ কোটি মানুষকে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়া সম্ভব হবে।
দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার প্রথম প্রয়োগ হয় ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি। রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে প্রয়োগের মাধ্যমে এই টিকা কার্যক্রম শুরু হলেও গণটিকা শুরু হয় ১০ দিন পর ৭ ফেব্রুয়ারি।
টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে শুরুতে মানুষের মধ্যে আগ্রহের ঘাটতি ছিল। এই টিকা নিলে মানুষ মারা যাবে, নানা শারীরিক ক্ষতি হবে; এমন কথাও মানুষকে টিকাবিমুখ করে তুলেছিল।
বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত কোভ্যাক্স প্রয়োগের মাধ্যমে। এই টিকা কিনতে চুরি হয়েছিল ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে।
সে সময় তিন কোটি ৪০ লাখ ডোজ টিকা কিনতে চুক্তি হলেও ভারতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় সে দেশের সরকার টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ফলে মার্চের পর কয়েক মাস ভারত থেকে বাংলাদেশে টিকা পাঠাতে পারেনি সিরাম।
সে সময়ে টিকা সংকট দেখা দেয়ায় পুরো টিকাদান কর্মসূচি একটি ধাক্কা খায়। কমে আসে কর্মসূচির গতি। এই পর্যায়ে বাংলাদেশ টিকা পেতে চীনের সঙ্গে চুক্তি করে। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে টিকা বিতরণে গড়ে তোলা আন্তর্জাতিক উদ্যোগ কোভ্যাক্সের মাধ্যমে কোটি কোটি টিকা আসতে থাকে।
এ অবস্থায় টিকার অনিশ্চয়তা দূর হওয়ার পর প্রয়োগের ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে কত মানুষকে তা দেয়া হবে। ইতিমধ্যে দেশে ২৪ কোটি টিকা এসে পৌঁছেছে। সরকারের হাতে এখনও পাঁচ কোটি টিকা মজুত রয়েছে।
২৩ জানুয়ারির ওই সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, ‘করোনা প্রতিরোধে ইতিমধ্যে ৯ কোটি ৮৯ লাখ মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দেয়া সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে ৬ কোটি ৪৬ লাখের বেশি।
‘এ ছাড়া ১ কোটি ৪১ লাখ শিক্ষার্থীকে করোনা টিকার প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে। ২৬ লাখের বেশি শিক্ষার্থী দ্বিতীয় ডোজ পেয়ে গেছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে ১ কোটি ৮১ লাখ ৮৪ হাজার টিকা দেয়া হয়েছে। এসব ক্লিনিকে ১ কোটি ৪ লাখের বেশি মানুষ দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করেছে। টিকার ব্যাপক মজুত থাকায় দেশে তৃতীয় টিকা বা বুস্টার ডোজের প্রয়োগও শুরু হয়েছে।’
পরিকল্পনার বাইরে পাঁচ কোটি মানুষ
বাংলাদেশের সরকার করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার আগের টার্গেট থেকে সরে এসেছে। এর আগে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায়, পর্যায়ক্রমে ৮০% মানুষকে করোনার টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন।
এরপর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজেও সংসদকে বলেন যে দেশের ৮০% মানুষকে টিকা দেয়া হবে। কিন্তু আজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানাচ্ছেন যে এই টিকা দেয়া হবে মোট জনগোষ্ঠীর ৭০% মানুষকে।
টিকা দেয়ার এই লক্ষ্যমাত্রা ১০% কমিয়ে আনা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি।
সেই হিসাবে এই জনসংখ্যা ৭০ ভাগ হল প্রায় ১২ কোটির মতো। সরকার এই ১২ কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার কথা বলছে।
বাকি ৫ কোটি জনগোষ্ঠীকে টিকার পরিকল্পনার বাইরে রাখার কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র রোবেদ আমিন বলেছেন, এর মধ্যে একটি বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠীর বয়স ১২ বছরের কম। এবং করোনাভাইরাসের টিকা এখন পর্যন্ত ১২ বছরের নীচে শিশুদের দেয়া হচ্ছে না।
তার মতে, ৭০% জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১২ বছরের বেশ বয়সী মানুষ কভার হবে। বাকি থাকবে শিশুরা, তাদের তো এই টিকা দেয়া হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি পরে শুরু হয়েছে। সরকার টিকাদানের পরিকল্পনা নিতে দেরি করেছেন। মাঝপথে এসে আবার ভারত থেকে টিকার সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
‘এ ছাড়া টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নে ৪০ শতাংশ জনবল কম থাকায় এটি স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। শুরুতে মানুষের মধ্যে টিকা নিতেও অনীহা ছিল। তবে গেল দুই মাসে টিকাদান কর্মসূচি গতি পেয়েছে। এই গতি অব্যাহত থাকলে আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।’
বিএসএমএমইউর ফারমাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘টিকা সংগ্রহে আমরা একটিমাত্র সোর্সের ওপর নির্ভর করেছিলাম। এ ছাড়া পাইপলাইনে থাকা টিকা আমরা সংগ্রহ করিনি। অনেক দেশ টিকা উৎপাদনে গুরুত্ব দিলেও আমরা দেইনি। ইরান, তাইওয়ান ও থাইল্যান্ডের মতো দেশ টিকা উৎপাদনে গুরুত্ব দিয়েছে।
‘এক সোর্সের টিকার ওপর নির্ভর করায় প্রায় ৬ মাস টিকাদান কর্মসূচিতে ধীরগতি ছিল। তবে চীন থেকে টিকার সরবরাহ আসার পর কিছুটা হলেও গতি বেড়েছে কর্মসূচিতে।’
ডা. সায়েদুর রহমান আরও বলেন, ‘আমরা সহজ পথে টিকা সংগ্রহ করতে পারিনি। অনেক রাষ্ট্র পরীক্ষামূলকভাবে টিকাদানে সম্মতি দিলেও এখানে সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। কূটনৈতিক তৎপরতাও ছিল না। এসব কারণে টিকাদান কর্মসূচিতে পিছিয়ে আছে দেশ।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ