সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের হাতে হাতির মৃত্যুর ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। খাবারের খোঁজে পাহাড় থেকে নেমে আসা হাতি মারা পড়ছে মানুষের পাতা ফাঁদে অথবা গুলিতে। সর্বশেষ শুক্রবার সকালে চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে আরও একটি এশিয়ান হাতির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গত পাঁচ দিনে এ নিয়ে সারাদেশে চারটি এশিয়ান হাতির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সবকটি হাতিই মারা গেছে মানুষের পাতা ফাঁদে অথবা গুলিতে। এরকম ঘন ঘন হাতি মারা যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বন বিভাগের হিসাবে, ২০২০ সালের বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে এবং গুলি করে দেশে ২২টি হাতি হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বন্যপ্রাণী গবেষক ও সংরক্ষণকর্মীদের হিসাবে এ সংখ্যা অন্তত ৩০টি। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে দুটি হাতি হত্যা করা হয়েছে! এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি হাতি হত্যার ঘটনা ঘটেছে বান্দরবানের লামা, দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার এলাকায়। এসব হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র তিনটি। সেসব মামলায় কারও শাস্তি তো দূরে থাক, গ্রেপ্তারও হয়নি কেউ।
বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬ বছরে ৫৪টি হাতি মারা গেছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই মারা গেছে মানুষের হাতে। আর এ সময়ে হাতির আক্রমণে ১৩৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ সময়ে হাতি হত্যা করার ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ১৪টি। তবে একটি মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি, কেউ সাজা পেয়েছে, এমন নজিরও নেই।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) হাতিকে বিশ্বজুড়ে বিপন্ন এবং বাংলাদেশে মহাবিপদাপন্ন প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা গণনার সর্বশেষ সমীক্ষাটি হয়েছে ২০১৬ সালে। সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে স্থায়ী হাতির সংখ্যা ২১০-৩৩০টি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশের মধ্যবর্তী সীমানা দিয়ে চলাচলকারী অভিবাসী হাতির সংখ্যা ৭৯-১০৭টি। একই সমীক্ষায় সারা দেশে পোষা হাতির মোট সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৯৬টি, যার মধ্যে ৪২টি পুরুষ ও ৫৪টি স্ত্রী। বন অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে হাতির সংখ্যা কমে ২৬০টিতে নেমে এসেছে।
২০১২ সালে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন বলছে, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স গ্রহণ না করে কোনো বাঘ বা হাতি হত্যা করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন। এ অপরাধের জন্য জামিন অযোগ্য হবেন এবং তিনি সর্বনিম্ন ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে বাঘ বা হাতির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে এবং এর ফলে জীবনাশঙ্কার সৃষ্টি হলে জীবন রক্ষার্থে আক্রমণকারী বাঘ বা হাতিকে হত্যার ক্ষেত্রে এ ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে না।
২০২০ সালের বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে এবং গুলি করে দেশে ২২টি হাতি হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বন্যপ্রাণী গবেষক ও সংরক্ষণকর্মীদের হিসাবে এ সংখ্যা অন্তত ৩০টি। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে দুটি হাতি হত্যা করা হয়েছে!
বন অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, মামলাগুলো শেষ পর্যন্ত তেমন একটা ধোপে টেকে না। ভাবটা এমন থাকে, হাতিই তো মারা গেছে, এর জন্য আবার এত কিছু করতে হবে কেন?
হাতি তৃণভোজী প্রাণী। এরা রাত-দিন সব সময়ই খাবারের খোঁজে একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়ায়। গাছের পাতা, বাঁশ, কলাগাছ, লম্বা ঘাস, ফুল, নারিকেল গাছের কচিপাতা ইত্যাদি খেয়ে থাকে। প্রতিদিন একটি পূর্ণবয়স্ক হাতি প্রায় ১৫০ কেজি খাবার খায় এবং ৮০ থেকে ১২০ লিটার পানি পান করে। বেশির ভাগ সময় এরা দল বেঁধে চলাচল করলেও কখনো কখনো পুরুষ হাতিকে দলছুট অবস্থায় দেখা যায়। হাতির প্রজনন কাল মার্চ থেকে জুন মাস। গর্ভধারণকাল প্রায় ২২ মাস। সাধারণত এরা দুই থেকে চার বছর পর পর একটি বাচ্চার জন্ম দেয়।
পৃথিবীতে বর্তমানে হাতির দুটি প্রজাতি বেঁচে আছে। এশীয় হাতি ও আফ্রিকা মহাদেশে বসবাসকারী আফ্রিকান হাতি। একটি হাতির দাঁত প্রায় ১.৮ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয় এবং একজোড়া দাঁতের ওজন হয় প্রায় ৭০ কেজির মতো। এই দাঁতের চাহিদার জন্যই বাংলাদেশ তথা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে হাতি। পৃথিবী জুড়ে হাতির দাঁতের অবৈধ ব্যবসা নিষিদ্ধ হলেও চোরা শিকারিরা তা মানছে না। এরা অর্থের লোভে প্রতিনিয়ত হাতি শিকার করছে।
হাতির দাঁতের বিভিন্ন শিল্পকর্ম জনপ্রিয়। হাতির দাঁত দিয়ে সিংহাসনের পা, আসবাবপত্র এবং মন্দির সাজানোর কাজ করা হয়। এখনো হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের সৌখিন জিনিসপত্র এবং অলঙ্কার সর্বজন সমাদৃত। মানুষের বিলাসিতায় অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে প্রকৃতির এই সৃষ্টি।
বর্তমানে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার হাতির আবাসস্থল ঝুঁকিতে। এ ছাড়া এ প্রাণীর বিচরণক্ষেত্র আর দরকার পর্যাপ্ত খাবার, পানি ও বিশ্রামের জায়গা। ক্রমাগত মানুষের আবাসভূমির বিস্তার, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ফসলি জমির বিস্তার, বনজ সম্পদের অতি আহরণ, পাহাড় কাটা, অপরিকল্পিতভাবে বনের মধ্যে রাস্তা নির্মাণ এবং বনসংলগ্ন নদীতে বাঁধ নির্মাণ এদেশে হাতির অস্তিত্বকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। হাতিকে বন্য পরিবেশ থেকে বিলুপ্তি রোধে সরকারি-বেসরকারি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি জনসচেতনতা বড় বেশি প্রয়োজন। এশীয় হাতির অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। বাংলাদেশের মধুপুর গড় থেকে শুরু করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নোয়াখালী এলাকায় একসময় হাতির অবাধ বিচরণ ছিল। বাসস্থান ধ্বংস, বন উজাড়, জনসংখ্যার চাপ, সংরক্ষণের অভাব, খাদ্যের অভাব ও চলাচলের পথে বাধার কারণে আমাদের দেশে হাতি এখন একটি বিপন্ন প্রাণী।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) হিসাবে শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের চেয়েও অনেক বেশি হাতি আছে। কিন্তু সেখানে হাতি এবং মানুষের পরিকল্পিত সহাবস্থানে কারণে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব প্রায় অনুপস্থিত। বন্যপ্রাণী গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন হাতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই পথে চলে। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কোনো পরিকল্পনা না নিয়ে উল্টো সংরক্ষিত বনের জমি দখল ও হাতি চলাচলের পথে ঘরবাড়ি, জমি, রাস্তা, রেললাইন নির্মাণের জন্য হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব বেড়েছে।
অবশ্য হাতি রক্ষায় বন অধিদপ্তর যে কোনো উদ্যোগ নেয়নি তা নয়। শেরপুরের যেসব এলাকায় হাতি বিচরণ করে সেসব অঞ্চলের জনগণকে সচেতন করতে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে হাতি রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধি, হাতি তাড়ানোর বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ-ভারত হাতির করিডোর ইত্যাদি কাজে আইইউসিএনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে বন অধিদপ্তর। কিন্তু সেসব টাকা, প্রকল্পের কার্যকারিতা ও আইইউসিএনের কাজ ইতোমধ্যেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, শেরপুরে হাতি জনবসতিতে এসে হামলা করছে না। হাতিদের তাড়া করা, ঢিল মারার কারণে তারা তেড়ে আসছে।
শেরপুরে হাতি-মানুষ এই দ্বন্দ্ব চলে আসছে বহু বছর ধরে। এই দ্বন্দ্বের ফলে সেখানে ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত বন্যহাতির আক্রমণে মানুষ মারা গেছেন ২৩ জন এবং আহত হয়েছেন ২৭ জন। এ সময় হাতি মারা গেছে ২৫টি। যার বেশিরভাগই বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে শেরপুরেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বন অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে হাতি হত্যা ও মারা যেতে থাকলে শিগগিরই এ দেশ থেকে প্রাণীটি বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই হাতি সংরক্ষণকে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হাতি সংরক্ষণের উদ্যোগগুলো কার্যকারিতা নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা পূর্বক প্রয়োজনে সংরক্ষণ কার্যক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে, তাহলেই ভবিষ্যতে হাতি সংরক্ষণ সম্ভব হবে।
তবে হাতি যদি বাঁচাতেই হয় তাহলে বন অধিদপ্তরের উচিত স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধি ও হাতির প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ বন্ধ করার পাশাপাশি বন দখল রোধ এবং বৈদ্যুতিক ফাঁদ অপসারণ করা। একইসঙ্গে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে হাতি হত্যাসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। এছাড়া বন সংলগ্ন এলাকায় হাতির অপছন্দের ফসল চাষাবাদ করে লোকালয়ে হাতির প্রবেশ বন্ধ করা যেতে পারে।
কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এদেশে কিছুই সম্ভব নয়। স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের আন্তরিক সহযোগিতা জরুরি। একইসঙ্গে গণমাধ্যমের উচিত হাতি-মানুষ দ্বন্দ্বে ঢালাওভাবে হাতিকে দায়ী না করে, মানুষকে উস্কে না দিয়ে বরং মানুষের অবৈধ এবং আগ্রাসী আচরণের সমালোচনা করা। প্রকৃতপক্ষে এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঠিক এবং শেষ সময়, বন অধিদপ্তর এই বন্যপ্রাণীটিকে আসলেই রক্ষা করতে চায় কিনা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৫
আপনার মতামত জানানঃ