বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, চোরা শিকার, আবাসস্থল ধ্বংসসহ নানা কারণে শৌর্য-বীর্যের প্রতীক বাঘের অস্তিত্ব বিশ্বজুড়েই হুমকির মুখে রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবনসহ ভারতের আরও কিছু অংশে পাওয়া যাওয়া বাংলার রাজকীয় বাঘদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। একসময় বাংলাদেশ-ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল দাপিয়ে বেড়ানো এই বাঘের বসতি এখন এসে ঠেকেছে শুধু সুন্দরবনে। কিন্তু এই বনেও প্রাণীটির সংখ্যা দিন দিন কমছে।
গত কয়েক সপ্তাহে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ত্রাস ছড়িয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার৷ বারবার জঙ্গল থেকে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে বাঘ৷ এতে হতাহত হচ্ছে মানুষ, গৃহপালিত পশু৷ কেন ঘনঘন বাঘ চলে আসছে গ্রামে?
জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের মাধ্যমে জানা যায়, গত দুই দশকের হিসাব দেখলে বোঝা যাবে, বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে৷ ২০০০ সাল থেকে প্রথম দশকে গড়ে বাৎসরিক মৃত্যু ২২-২৩ জনের৷ ২০১০ থেকে পরের দশকে এই সংখ্যাটা নেমে আসে ৮-৯ জনে৷ সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে দক্ষিণ ২৪ পরগনার যে তিনটি ব্লকে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাঘের হামলার শিকার হয়, সেগুলি হলো গোসাবা, কুলতলি ও বাসন্তী৷ সবচেয়ে বেশি বাঘের হামলার খবর গোসাবা থেকে পাওয়া যায়৷
গত বুধবার জনপদে ঢুকে পড়া একটি বাঘ বনকর্মীরা খাঁচায় ভরেছে৷ শেষ আড়াই মাসে বাঘের গ্রামে অনুপ্রবেশের ঘটনা দশেরও বেশি৷ ফলে সুন্দরবনের এই তিনটি ব্লকে এখন ভরপুর আতঙ্ক৷
এর আগেও বারবার লোকালয়ে এসে পড়েছে বাঘ৷ এটা বাঘের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বলেই বিশেষজ্ঞদের দাবি৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অংশে গত নভেম্বর মাস থেকে অপেক্ষাকৃত ঘনঘন রয়েল বেঙ্গল ঢুকে পড়েছে গ্রামে৷ কোথাও বাঘের হামলায় গ্রামবাসী বা মৎস্যজীবীর মৃত্যু হয়েছে, কোথাও গৃহপালিত পশু মারা পড়ছে৷ একাধিক বিশেষজ্ঞ এজন্য বাঘের খাদ্যাভাবকে দায়ী করেছেন৷
বিভিন্ন কারণে বনাঞ্চলে খাদ্যের অভাব হতে পারে৷ ‘ইন্টারন্যাশানাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার’ সংগঠনের দীর্ঘদিনের ক্যাট স্পেশ্যালিস্ট প্রণবেশ সান্যাল ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘সুন্দরবনের জঙ্গল আরও ঘনত্বপ্রাপ্ত হয়েছে, ফলে শিকার বাঘের চোখে পড়ছে না৷ বাঘ যদি বুড়ো হয় তাহলে সমস্যা আরো বেশি৷ অথচ সেই বাঘ নদীর ওপারে ফাঁকা জমিতে গবাদি পশু চরতে দেখছে৷ সেগুলি ধরতে লোকালয়ে চলে আসছে’৷
শুধু সেটাই কি রয়্যাল বেঙ্গলের লোকালয়ে ঘনঘন এসে পড়ার কারণ?
বাঘ যাতে গ্রামে ঢুকে না পরে সেজন্য জাল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে বনদপ্তর৷ কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক জায়গায় জাল ছিন্ন হয়ে গেছে৷ তার ফাঁক গলে শিকারের সন্ধানে থাকা বাঘ লোকালয়ে চলে আসছে৷ ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফান্ড ফর নেচার, ডাব্লিউডাব্লিউএফ সুন্দরবন প্রোগ্রামের অধিকর্তা অনামিত্র অনুরাগ দণ্ড মনে করেন, ‘হতে পারে জাল মানুষই নষ্ট করেছে, জালগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার৷ এছাড়া জঙ্গলে বাঘের জায়গা বাড়ছে না, বংশবৃদ্ধি হলে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাবেই’৷
রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য খাদ্যাভাবের কারণটি নাকচ করেছেন৷ তার মতে, খাবারের অভাব হয়নি৷ এটা বাঘের বংশবিস্তারের সময়৷ তাই সঙ্গীর খোঁজে তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়৷ সেই ফাঁকে বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে৷
এই দাবির সমর্থনে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর জোন্স জাস্টিন বলেন, ‘এটা বাঘের প্রজননের সময়৷ বাঘ বা বাঘিনীর বয়স বেশি হলে তাকে তার রাজত্ব থেকে সরে আসতে বাধ্য করা হয়৷ তবে এটাই একমাত্র কারণ নাও হতে পারে’৷’
নির্দিষ্ট কোনো একটি কারণে বাঘ লোকালয়ে চলে আসে না৷ অনেকগুলি কারণ এর পেছনে থাকতে পারে৷ এমনটাই মনে করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগের সহকারী অধিকর্তা শিবাজী ভট্টাচার্য৷
তিনি বলেন, ‘লোকালয়ে বাঘ না বাঘিনী হাজির হচ্ছে, সেটাও জানাতে হবে৷ বাঘিনী এই মৌসুমে বাঘকে আহ্বান করে৷ কোনো বাঘ তার প্রস্তাবে রাজি না হলে বাঘিনীকে তাড়িয়ে বের করে দেয়৷ বাঘিনীকে নিজের বাসস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হয়৷ স্থানান্তরের সময় গ্রামে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা থাকেই’৷
‘সুন্দরবনের জঙ্গল আরও ঘনত্বপ্রাপ্ত হয়েছে, ফলে শিকার বাঘের চোখে পড়ছে না৷ বাঘ যদি বুড়ো হয় তাহলে সমস্যা আরো বেশি৷ অথচ সেই বাঘ নদীর ওপারে ফাঁকা জমিতে গবাদি পশু চরতে দেখছে৷ সেগুলি ধরতে লোকালয়ে চলে আসছে’৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের বিভিন্ন ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্পে বনাঞ্চলের সীমানা নির্দিষ্ট৷ কিন্তু সুন্দরবনের ক্ষেত্রে তা নয়৷ সুন্দরবনের ক্ষেত্রে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে সঙ্গে বাঘের বিচরণভূমি কমে যায়৷ একটি বাঘের জন্য দশ বর্গ কিলোমিটার বাসস্থান দরকার হয় ডাঙায়৷ সেটা সুন্দরবনে সবসময় পাওয়া যায় না৷ এমনকি যাত্রিবাহী ভেসেল, মাছ ধরার ট্রলার ঢুকে পড়েও বাঘকে বিরক্ত করতে পারে৷ একই বাঘ নাকি আলাদা বাঘ বেরোচ্ছে সেটাও দেখতে হবে৷
এদিকে দেশটিতে চলতি বছরে নানা কারণে মারা গিয়েছে ১২৬টি বাঘ। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ‘জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ’ (এনটিসিএ) এই পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছে, গত এক দশকে বাঘের বার্ষিক মৃত্যুর রেকর্ড গড়েছে ২০২১।
২০১২ সাল থেকে বাঘের মৃত্যু নিয়ে কাজ শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ‘জাতীয় ব্যাঘ্র সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ’ (এনটিসিএ)। তাদের রেকর্ড থেকে দেখা যাচ্ছে, গত দশ বছরের মধ্যে সব থেকে বেশি বাঘের মৃত্যু হয়েছে গত বছরে। গত বছরে অর্থাৎ ২০২১ সালে ১২৬টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর আগের বছর যে সংখ্যাটা ছিল ১০৬।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে কমছে বাঘের অনুকূল পরিবেশ, বাড়ছে প্রতিকূলতা। দূষণ, গাছ কাটা, অপরিকল্পিত পর্যটন, পিটিয়ে হত্যা ও শিকার বন্ধ হয়নি। মানুষের এসব আগ্রাসনের পাশাপাশি রয়েছে প্রাকৃতিক হুমকি। অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বার্ধক্যজনিত কারণেও মারা যাচ্ছে বাঘ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনে জোয়ারের সময় বনভূমি ডুবে যাওয়ায় কমেছে বাঘের বিচরণক্ষেত্র। পাশাপাশি লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় মিষ্টি পানি পাচ্ছে না বাঘ। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বন বিভাগ ও সুন্দরবন-সংশ্নিষ্টরা।
বাঘের আস্তানা গুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে, তার সাথে সমুদ্রতল বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যোগ করে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে, ২০৭০ সাল নাগাদ সুন্দরবনের এরকম কোন জায়গা থাকবে না যা বাঘের বসতির জন্যে আদর্শ। ২০৫০ সালের মধ্যে বাঘের হ্যাবিট্যাট কমে যাবে প্রায় ৯৬ শতাংশ। এই গবেষণা এপার বাংলা এবং ওপার বাংলা দুই বাংলার ক্ষেত্রেই সত্যি।
শুধুমাত্র সমুদ্রের জল বেড়ে যাওয়াই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে মিষ্টি জলের পুকুরে নোনা জল ঢুকে যাওয়া, শিকারের অভাব এবং নানাবিধ সাইক্লোনের সংখ্যা যেভাবে গত কয়েক বছরে বেড়ে যাচ্ছে তাতে সুন্দরবনের বাঘ তথা যে কোন পশুপাখির বাসস্থানই সাংঘাতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। সাথে যোগ হয়েছে বাঘের খাবার অর্থাৎ হরিণ, শুয়োর, বাঁদর, মাছ এবং কাঁকড়ার বেআইনি শিকার এবং ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিনাশ। বিজ্ঞানিরা বলছেন শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র বাঘকে কেন্দ্র করে জল-জঙ্গলকে বাঁচাবার প্রয়াস করতে হবে সরকারকে।
সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় গড়ে তোলা শতাধিক ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, ফুড সাইলো এবং বনের মধ্য দিয়ে চলাচল করা জাহাজের দূষণ বাঘের ক্ষতি করছে। গাছ কাটা, খাদ্য সংকট, বিষ দিয়ে মাছ ধরা ও অপরিকল্পিত পর্যটনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের ওপর। এ ছাড়া লোকালয়ে চলে আসায় পিটিয়ে হত্যার পাশাপাশি রয়েছে পাচারের উদ্দেশ্যে বাঘ শিকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংকট সমাধানে এখনই বাঘ শিকার রোধ করতে হবে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধেও কাজ করতে হবে। সুন্দরবনের মতো এ রকম জায়গা বিশ্বের আর কোথাও নেই। তাই বাঘকে বাঁচাতে হলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১৪
আপনার মতামত জানানঃ