মানুষের চাহিদার প্রেক্ষিতেই বিশ্বজুড়ে বাড়ছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এতে ধ্বংস হচ্ছে বাঘ ও জাগুয়ারের মতো প্রাণীদের বসতি। ফলে আশঙ্কাজনক হারে কমে আসছে এসব প্রাণীর সংখ্যা। স্বাভাবিক অবস্থানে থাকা প্রাণীগুলো চলে যাচ্ছে বিপন্ন প্রাণীদের কাতারে। নতুন এক গবেষনা রিপোর্টের বরাতে বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, জলবিদ্যুতের জন্য বাঁধ নির্মাণের ফলে বিশেষভাবে এশিয়ার দেশগুলোতে বাঘের মোট সংখ্যার এক পঞ্চমাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুশ্চিন্তার বিষয় হল যে, গবেষণার ফলাফল বলছে কোনো কোনো দেশের অরণ্যে বাঘের সংখ্যা নিশ্চিহ্ন হতে চলছে। এমনকি কোনো কোনো দেশে বাঘের জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এর পেছনে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে গবেষণায় বলা হচ্ছে।
বলা হচ্ছে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হলে বিশাল এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। এতে পাঁচটি বাঘের অন্তত একটি তার আবাসস্থান হারায়। আবার বিশাল বন পানিতে ডুবে যাওয়ায় স্বাভাবিক বনভূমি পরিণত হয় ছোট ছোট দ্বীপে, যা বাঘ ও জাগুয়ারের মতো প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবন ধারণের জন্য উপযোগী নয়। ফলে তারা সেসব স্থান থেকে চলে যাচ্ছে।
গবেষকরা জলবিদ্যুতের সাথে সম্পর্কিত আরেকটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন। সেটি হচ্ছে, কোনো স্থানে জলবিদ্যুৎ স্থাপন করা হলে সেখানে বাস্তবতার খাতিরেই অনেক বেশি রাস্তাঘাট তৈরি করতে হয়। এর ফলেও বনের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বনের অখণ্ডতা নষ্ট হচ্ছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাঘ ও জাগুয়ারের মতো প্রাণীদের ওপর।
আধুনিক বিশ্ব বাঘের সাথে নির্মম আচরণ করেছে। একটি হিংস্র প্রাণী হিসেবে পরিচিত হলেও গত ১০০ বছরে বাঘের ৯০ শতাংশ আবাসভূমি ধ্বংস হয়েছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে বাঘের সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও পরিবেশ সংস্থা আইইউসিএন একে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রেখেছে। কমতে কমতে সারা বিশ্বে এখন বাঘের মোট সংখ্যা প্রায় ৩,৫০০।
অভিন্ন পরিস্থিতি জাগুয়ারের বেলাতেও। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় বসবাস করত জাগুয়ার। কিন্তু জলবিদ্যুৎ নামের অভিশাপে তাদের সংখ্যা কমে এখন অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে।
আধুনিক বিশ্ব বাঘের সাথে নির্মম আচরণ করেছে। একটি হিংস্র প্রাণী হিসেবে পরিচিত হলেও গত ১০০ বছরে বাঘের ৯০ শতাংশ আবাসভূমি ধ্বংস হয়েছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে বাঘের সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও পরিবেশ সংস্থা আইইউসিএন একে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রেখেছে। কমতে কমতে সারা বিশ্বে এখন বাঘের মোট সংখ্যা প্রায় ৩,৫০০।
এ বিষয়ে গবেষক অ্যানা ফিলিপা পামেরিম বলেন, বিশ্বজুড়ে অন্তত ১০০টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাঘ ও জাগুয়ারের বিচরণক্ষেত্রগুলোকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। কোথাও বা হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের সময় রাস্তাঘাট তৈরি করতে হয়। এর ফলে যেসব অরণ্য অখণ্ড ছিল তা কেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে স্বাভাবিক পরিবেশ হারিয়েছে বনের রাজা খ্যাত বাঘ, জাগুয়ারসহ অন্যান্য প্রাণী।
চীনের শেনজেনে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষক ড. লুক গিবসন বলেন, এসব বাঁধ বা জলাধার নির্মাণ করা না হলে বাঘের সংখ্যা এখনকার চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ বেশি থাকতো।
এ অবস্থায় গবেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, যে উন্নতির আশায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বসানো হচ্ছে, তা কি পরিবেশের এসব ক্ষতিকেও ছাপিয়ে যেতে পারবে? এ অবস্থায় আরো বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই ভূমি পরিকল্পনাকারী, জ্বালানি উৎপাদক এবং প্রকৌশলীদের সাথে নিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণকারীদের কাজ শুরু করতে হবে। আর তা না হলে এসব প্রাণী হয়ত পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানব কর্মকাণ্ডের কারণে প্রাণী ও উদ্ভিদের ৮০ লাখ প্রজাতির মধ্যে ১০ লাখ বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে কয়েক দশকের মধ্যেই।
যেসব গবেষণার ভিত্তিতে জাতিসংঘ এ আশঙ্কার কথা বলছে, সেগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার যৌথভাবে করা। সেখানে বলা হয়েছে, ‘চার হাজার বর্গমাইলের সুন্দরবনের ৭০ শতাংশ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক ফুট ওপরে রয়েছে। ২০৭০ সালের মধ্যে সেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য বাসযোগ্য কোনো অঞ্চল থাকবে না।’
২০১০ সালে করা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ডের জরিপের ভিত্তিতে জাতিসংঘ বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১ ইঞ্চি বাড়লে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে সুন্দরবনের ৯৬ শতাংশ রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত শতাব্দীর শুরুতে পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা ছিল এক লাখের মতো। কিন্তু আবাসভূমি হারানো, পাচার ও শিকারের কারণে এদের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে চার হাজারে। সুন্দরবনে যে কয়েকটি বাঘ আছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সেগুলোর টিকে থাকা হুমকির মুখে পড়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের উদ্ভিদকুলে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। এটিও রয়েল বেঙ্গল টাইগার কমে যাওয়ার একটি কারণ। এ ছাড়া রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং সেখানকার বাসিন্দাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার যৌথ গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন ঢাকার ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শরিফ এ মুকুল। তার বরাত দিয়ে জাতিসংঘ বলছে, ‘ভবিষ্যতে সুন্দরবনে যেকোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় হলে, কোনো রোগ ছড়িয়ে পড়লে কিংবা খাদ্যসংকট দেখা দিলে সেখানে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জোয়ারের উচ্চতা বাড়ছে। কিন্তু জাতিসংঘ বলছে, বাংলাদেশে জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধির হার বৈশ্বিক গড় হারের চেয়ে অনেক বেশি।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের বাঘ সুরক্ষা কার্যক্রমের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বে ৩ হাজার ৮৯০টি বাঘ রয়েছে। এর মধ্যে ভারত বাঘের সংখ্যা দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ২২৬টি করেছে। নেপাল ১০০টি থেকে বাড়িয়ে ১৯৮টি, ভুটান ৫০টি থেকে ১০৩টি করেছে। থাইল্যান্ড বাঘের সংখ্যা ৯০টি থেকে ১৮৯টি করেছে। আর চীনে বাঘের সংখ্যা সাতটি, লাওসে দুটি, ভিয়েতনামে পাঁচটিতে নেমে এসেছে। আর কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশে ২০০৪ সালের পায়ের ছাপ গুনে করা জরিপে ৪৪০টি বাঘ থাকার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ক্যামেরা ফাঁদের মাধ্যমে করা জরিপে বাঘের সংখ্যা বেরিয়ে আসে ১০৬টি। এরপর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আরেকটি শুমারি করে জানায়, বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। ২০২১ সালে বাংলাদেশের আরেকটি জরিপ করার কথা থাকলেও তা এ বছর না–ও হতে পারে।
সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় গড়ে তোলা শতাধিক ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, ফুড সাইলো এবং বনের মধ্য দিয়ে চলাচল করা জাহাজের দূষণ বাঘের ক্ষতি করছে। গাছ কাটা, খাদ্য সংকট, বিষ দিয়ে মাছ ধরা ও অপরিকল্পিত পর্যটনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের ওপর। এ ছাড়া লোকালয়ে চলে আসায় পিটিয়ে হত্যার পাশাপাশি রয়েছে পাচারের উদ্দেশ্যে বাঘ শিকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সংকট সমাধানে এখনই বাঘ শিকার রোধ করতে হবে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধেও কাজ করতে হবে। সুন্দরবনের মতো এ রকম জায়গা বিশ্বের আর কোথাও নেই। তাই বাঘকে বাঁচাতে হলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০২
আপনার মতামত জানানঃ