আজ ২৯ জুলাই, বিশ্ব বাঘ দিবস। বাঘের প্রাকৃতিক আবাস রক্ষা করা এবং বাঘ সংরক্ষণের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রতি বছরের ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালন করা হয়। ২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ অভিবর্তনে এ দিবসটির সূচনা হয়।
২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম বাঘ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ নিজ নিজ দেশে বাঘের সংখ্যা ১২ বছরের মধ্যে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়েছিল। এর মধ্যে নেপাল বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। ভারত এবং ভুটানও দ্বিগুণের কাছাকাছি নিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা সামান্য বাড়লেও সে লক্ষ্য থেকে দূরে আছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের হিসাব মতে, ২০০৪ সালের জরিপ অনুসারে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৪৪০টি। ২০১৮ সালের জরিপে দেখা যায়, তা কমে হয়েছে ১১৪টি। ২০০১ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘ মারা গেছে কমপক্ষে ৪৬টি। এর মধ্যে প্রাকৃতিক কারণে মরেছে ৮ বাঘ।
বিভিন্ন সময় শিকারিদের হাতে বাঘ মরেছে ১৩টি। লোকালয়ে প্রবেশ করায় স্থানীয়দের হাতে মারা গেছে ৫ বাঘ। এ ছাড়া, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে মারা গেছে এক বাঘ। বিভিন্ন সময় দুর্বৃ্ত্তদের হাতে মারা যাওয়া ১৯টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করেছে বন বিভাগ।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। ১৯৮২ সালের জরিপে দেখা যায় বাঘের সংখ্যা ৪২৫টি। ১৯৮৪ সালে সুন্দরবনের ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি, ২০০৪ সালের জরিপে ৪৪০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। ২০১৫ সালে ‘ক্যামেরা ট্র্যাকিং’ পদ্ধতিতে পরিচালিত জরিপে বাঘের সংখ্যা বলা হয়েছে ১০৬টি। ২০১৮ সালে করা একটি জরিপের ফলাফলে বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ১১৪টি।
অর্থ্যাৎ দেড় যুগের ব্যবধানে ৩২৬টি বাঘ কমেছে সুন্দরবনে। আর কয়েক বছরে বেড়েছে আটটি বাঘ। তবে বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘের আনাগোনা বাড়ছে। সম্প্রতি সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বাঘের অবাধ বিচরণ ও প্রতিনিয়ত বাঘ শাবকের দেখা মিলছে বলে জানান সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালিরা।
সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়বে বলে আশাবাদী বন বিভাগ ও সুন্দরবন সংশ্লিষ্টরা। সুন্দরবনে বাঘের আনাগোনা বেড়ে যাওয়া ও বাঘ দেখতে পাওয়াকেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তারা।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, চোরা শিকার, আবাসস্থল ধ্বংসসহ নানা কারণে শৌর্য-বীর্যের প্রতীক বাঘের অস্তিত্ব বিশ্বজুড়েই হুমকির মুখে রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবনসহ ভারতের আরও কিছু অংশে পাওয়া যাওয়া বাংলার রাজকীয় বাঘদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। একসময় বাংলাদেশ-ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল দাপিয়ে বেড়ানো এই বাঘের বসতি এখন এসে ঠেকেছে শুধু সুন্দরবনে। কিন্তু এই বনেও প্রাণীটির সংখ্যা দিন দিন কমছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে কমছে বাঘের অনুকূল পরিবেশ, বাড়ছে প্রতিকূলতা। শুধু সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়; পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চিতা ও মেছোবাঘ বিলুপ্তির পথে।
বিশ্লেষকরা বলেন, সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরা, হরিণ শিকার বন্ধ করতে হবে। এমন ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের তথ্য প্রশাসন ও বন বিভাগকে জানাতে হবে। এছাড়া সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। সুন্দরবনের ক্ষতিসাধনের কারণে বাঘ হারিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বহু দেশ বাঘকে কেন্দ্র করেই সুন্দরবনকে চেনে আবার সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে চেনে। সে কারণে বাঘ সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সবার।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে কমছে বাঘের অনুকূল পরিবেশ, বাড়ছে প্রতিকূলতা। শুধু সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়; পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চিতা ও মেছোবাঘ বিলুপ্তির পথে। দূষণ, গাছ কাটা, অপরিকল্পিত পর্যটন, পিটিয়ে হত্যা ও শিকার বন্ধ হয়নি। মানুষের এসব আগ্রাসনের পাশাপাশি রয়েছে প্রাকৃতিক হুমকি। অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বার্ধক্যজনিত কারণেও মারা যাচ্ছে বাঘ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনে জোয়ারের সময় বনভূমি ডুবে যাওয়ায় কমেছে বাঘের বিচরণক্ষেত্র। পাশাপাশি লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় মিষ্টি পানি পাচ্ছে না বাঘ। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বন বিভাগ ও সুন্দরবন-সংশ্নিষ্টরা।
সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় গড়ে তোলা শতাধিক ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, ফুড সাইলো এবং বনের মধ্য দিয়ে চলাচল করা জাহাজের দূষণ বাঘের ক্ষতি করছে। গাছ কাটা, খাদ্য সংকট, বিষ দিয়ে মাছ ধরা ও অপরিকল্পিত পর্যটনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের ওপর। এ ছাড়া লোকালয়ে চলে আসায় পিটিয়ে হত্যার পাশাপাশি রয়েছে পাচারের উদ্দেশ্যে বাঘ শিকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমাদের বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা দূরে থাক, আদৌ সুন্দরবনে কোনোমতে টিকে থাকা বাঘগুলো শেষ পর্যন্ত টিকবে কি না, সেই প্রশ্ন করতে হবে। সরকারের উচিত নিজ উদ্যোগে বাঘের সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া।’
তারা বলেন, সংকট সমাধানে সুন্দরবনকে এখনই সংরক্ষণ করে বাঘ শিকার রোধ করতে হবে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধেও কাজ করতে হবে। সুন্দরবনের মতো এ রকম জায়গা বিশ্বের আর কোথাও নেই। তাই বাংলার বাঘকে বাঁচাতে হলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ করতে হবে।
তারা বলেন, বাংলাদেশকে বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হলে বন বিভাগের পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৩
আপনার মতামত জানানঃ