চট্টগ্রামসহ সারাদেশে হাতির মৃত্যুর ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। আবার হাতির আক্রমণে সাধারণ মানুষের হতাহতের ঘটনাও বাড়ছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন হাতির বিচরণ করা এলাকার মানুষজন। অন্যদিকে একের পর এক হাতি মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
বছরের পর বছর ধরে বন্যহাতি আতঙ্কে আছে গারো পাহাড়ের সীমান্তের তিন উপজেলার মানুষ। দীর্ঘদিন হাতি আর মানুষের মধ্যে লড়াই চলছেই। খাদ্য সংকটেরসহ নানা কারণে প্রায়শই হাতি-মানুষ মুখোমুখি হচ্ছে। এতে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ-হাতি উভয়ই।
সবশেষ ২ আগস্ট রাতে ছমেদ আলী (৬৫) উরফে আহালু নামে এক বৃদ্ধ হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যান। এতে গত আট বছরে হাতির আক্রমণে মানুষ মারা গেছে ২৪ জন। আর ছোট-বড় মিলে মারা গেছে ২৮টি হাতি।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, ভারত থেকে এসে শতাধিক বন্যহাতি দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করেছে। প্রথম দিকে হাতির সংখ্যা কম হলেও বংশানুক্রমে বর্তমানে তাদের সংখ্যা শতাধিক। অন্যদিকে ক্রমান্বয়ে বনাঞ্চল দখল করে মানুষ বসবাস শুরু করায় হাতির আবাসস্থল সংকুচিত হচ্ছে। ফলে হাতি দল বেঁধে প্রায়ই খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসী এবং বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রায় দুই যুগ ধরে গারো পাহাড়ে শতাধিক বন্যহাতি কয়েকটি উপ-দলে বিভক্ত হয়ে লোকালয়ে হামলা দিচ্ছে। এতে মাঝেমধ্যেই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শত শত একর জমির মৌসুমি ফসল লন্ডভন্ড ঘরবাড়ি। পাহাড়ি মানুষের জীবন এখন হুমকির মুখে।
জানা যায়, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী নাকুগাঁও স্থলবন্দর, কাটাবাড়ী, পানিহাটা, খলচান্দা, দাওধারা, বাতকুচি, বুরুঙ্গাসহ প্রায় ১২টি গ্রাম, শ্রীবরদীর কর্ণঝোড়া, বাবলাকোনা, রাজারপাহাড়, কোচপাড়া, খাড়ামোরা, মেঘাদলসহ ১৩টি গ্রামে ও ঝিনাইগাতীর বড়গজনী, ছোটগজনী, রাংটিয়া, সন্ধ্যাকুড়া, নকশী, দুধনইসহ প্রায় ১৩টি গ্রামে প্রায় অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করছে। হাতি পাহাড়ে বসবাসরত বাড়িঘরে, ফসলাদির জমিতে ও বিভিন্ন বাগানে প্রবেশ করে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। নালিতাবাড়ী উপজেলার পানিহাটা এলাকার বিজার কুবি জানান, বন্যহাতি ঢাকঢোল পটকা ও আগুনকে ভয় পায়। এলাকাবাসী মশাল-আবর্জনা জ্বালিয়ে হই-হুল্লোড়, ঢাকঢোল পিটিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করে।
শেরপুরের বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা সুমন সরকার বলেন, মানুষ এবং হাতিকে বাঁচাতে ইতিমধ্যেই সরকার গারো পাহাড়ে হাতির জন্য অভয়ারণ্য সৃষ্টি করেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। পাশাপাশি পাহাড়ি মানুষদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সভা-সেমিনার করা হচ্ছে।
তিনি জানান, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের ২ আগস্ট পর্যন্ত জেলার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী এবং নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় ২৮টি বন্যহাতির মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে প্রাণ গেছে ২৪ জন মানুষের।
পাহাড় কাটায় হাতির আবাসস্থল ও খাদ্য কমে যাওয়া, চলাচলের পথ (করিডোর) বাধাগ্রস্ত, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও ফাঁদ পেতে হাতি হত্যার কারণে বার বার লোকালয়ে নেমে আসে বন্য হাতি।
এদিকে চট্টগ্রামে হাতির আক্রমণে প্রাণহানির ঘটনা বেড়ে চললেও তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই প্রশাসনের। গত ৫ বছরে হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। পাহাড় কাটায় হাতির আবাসস্থল ও খাদ্য কমে যাওয়া, চলাচলের পথ (করিডোর) বাধাগ্রস্ত, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও ফাঁদ পেতে হাতি হত্যার কারণে বার বার লোকালয়ে নেমে আসে বন্য হাতি।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা প্রতিষ্ঠান আইইউসিএন, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে হাতির আক্রমণে হতাহতের ঘটনা বেড়ে চললেও বন বিভাগের দায়িত্বহীনতার অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে হাতি হত্যার মামলা জামিনের অযোগ্য। অপরাধীকে সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ দেওয়ার বিধান রয়েছে। একই অপরাধ পুনরায় করলে সাজা সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদ এবং সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা।
বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে হাতি হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৪টি। তবে একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি। কেউ সাজা পেয়েছে- এমন নজির নেই।
হাতির বিচরণ নিয়ে ২০১৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) গবেষণায় বলা হয়, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হাতির আবাসভূমি ও চলাচলের পথগুলো নিয়মিতভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। সেখানে গাছপালা কেটে ফসলের চাষ হচ্ছে। বনের বাইরেও ধানের চাষ বাড়ছে। খাদ্য সংকটে অভুক্ত হাতি আমন ধান পাকলে তা খেতে বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। এ সময় কিছু মানুষ বিদ্যুতের তারের ফাঁদ পেতে অথবা গুলি করে হাতি মেরে ফেলছে।
বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় থাকা এশীয় হাতির এভাবে একের পর এক মৃত্যুতে উদ্বেগ জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা। নির্বিচারে বন্য হাতি হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে তারা বলেছে, হাতি রক্ষায় প্রশাসনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হলে বাংলাদেশ থেকে এশীয় হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা পরিবেশবাদীদের।
গবেষকরা বলছেন, যে হারে হাতি মারা যাচ্ছে। হাতির প্রজনন আর মৃত্যু হিসাব করলে বলা যায়, বাংলাদেশ থেকে শিগগির এশিয়ান হাতির বিলুপ্তি ঘটবে।
তারা বলেন, হাতির প্রজনন হার খুবই কম। একটি হাতি চার বছরে একটি শাবকের জন্ম দেয়। দেশে হাতির সংখ্যা ও মারা যাওয়ার হার হিসাব করলে বলা যায়, বাংলাদেশ থেকে এশিয়ান হাতি বিলুপ্ত হতে বেশি দিন লাগবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৩
আপনার মতামত জানানঃ