বাংলাদেশের বনবিভাগ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা-আইইউসিএন’র সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেশে এশিয়ান বন্যহাতি রয়েছে ২৬৮টি। দেশের সীমান্তবর্তী পাঁচটি বনাঞ্চলে ৯৩টি পরিযায়ী হাতি বিচরণ করে। এছাড়াও সরকারের অনুমতিক্রমে দেশে ১০০টি পোষা হাতি আছে। কিন্তু দিন দিন মারা যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে আর হাতির এই পরিসংখ্যান কমছে। গত একবছরে দেশে ২২টি হাতি মারা গেছে। এর মধ্যে চলতি মাসে মারা গেছে চারটি হাতি। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ করা হয়েছে, হাতিগুলোকে গুলি করে, বিষ প্রয়োগ অথবা বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর কক্সবাজারসহ সীমান্তের পাহাড়ি বনাঞ্চলে চলাচল করতে গিয়ে বন্য হাতিরা বাধার মুখে পড়ছে, একথা সবারই জানা। রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী শিবির নির্মাণ করতে অসংখ্য বন ও গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে। রোহিঙ্গা আসার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৫ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে বন্য হাতির আক্রমনে। আর তাই তাদের প্রথম টার্গেট দক্ষিণ টেকনাফ বনাঞ্চল হাতি যেন টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড়ি অঞ্চল হয়ে হিমছড়ি বনাঞ্চলের দিকে আসতে না পারে। আর তাই হাতির চলাচলের মূল পথ বন্ধ করতে হোয়াইক্যং জাতীয় উদ্যানের অভ্যান্তরে প্রায় ১৫০০ একর সংরক্ষিত বনকে ঘিরে পুটিবিনিয়া ও চাকমার কুল নামে কয়েক লক্ষ্য রোহিঙ্গা নিয়ে বিশাল দুটি রোহিঙ্গা বসতি গড়ে তুলে। তাতে এই অঞ্চলের ৬৮ টি হাতির প্রায় ৪০ টি দক্ষিণ টেকনাফ অঞ্চলে ও অবশিষ্ট হাতগুলো হিমছড়ি বনাঞ্চলের আশেপাশে থাকাতে দু’ ভাগ হয়ে যায়। এতে পরিকল্পিত ফাঁদে আটকা পড়ে টেকনাফ উপকূলে থাকা ৪০ টি হাতি।
যারা নাফ নদীর কারণে পূর্বদিকে যেতে পারছেনা। আর পশ্চিমে যেতে পারছেনা বঙ্গোপসাগরে কারণে। আর উত্তর ও দক্ষিণ পাশকে ঘিরে ৩২ টি রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের গণবসতি। তারা পরিকল্পিতভাবে কিছু বুদ্ধিমান প্রাণীর চাহিদা ও গতিবিধি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষের পরামর্শে হাতির ১২টি করিডোর ও ২২টি প্রাকৃতিক জলাধার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে বসতি গড়ে তুলেছে। প্রাকৃতিক খাল, ছড়া ও ঝিরিগুলোও বাধ দিয়ে মাটি কেটে ভরাট করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। যাতে হাতিরা কখনো কোনোদিন এ-পথে না আসে! তারা হাতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে ৯৪ টি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের পাশাপাশি প্রতিটি পয়েন্টে দেশীয় এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রধারীদের নিয়োগ করেছে সন্তর্পণে।
তাদের এখন প্রতিটি মুহূর্তে একটাই ভয় যেকোন মুহূর্তে হাতির সমগ্র পাল একসাথে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আক্রমণ করতে পারে, ঘটতে পারে ইতিহাসের ভয়ংকর এক অধ্যায়। কারণ তারা জানে তারা কি করেছে। আর হাতিরা নিজেদের অধিকার রক্ষায় উত্তেজিত হয়ে যে হামলা চালাতে পারে তা শতভাগ নিশ্চিত। যদিও বর্ষায় তারা ঐ অঞ্চলে বন্ধী অবস্থায় মরতে মরতে টিকে থাকলেও গরম বাড়লে, পাহাড়ে খাদ্য ও পানির সংকট সৃষ্টি হলেই তারা আক্রমণ করবে তা নিশ্চিত ।
বনভূমিসংলগ্ন এলাকায় যারা বাস করে তারা হাতি তাড়ানোর জন্য নানা পদ্ধতি বেছে নেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক পদ্ধতি হলো আগ্নেয়াস্ত্র। আবার বনভূমি দখলবাজদের নেপথ্যেও একটি গ্রুপ নীরবে হাতি হত্যার কাজে ইন্ধন জোগায় বলে অভিযোগ রয়েছে। একসময় হাতির দাঁত ও হাড়গোড় পাচারকারীচক্রও এ-অঞ্চলে তৎপর ছিল। তারা নানা কৌশলে বন্য হাতি হত্যার পর দাঁত ও হাড়গোড় সংগ্রহ করে পাচারের কাজে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাচারকারীচক্র বনভূমি দখলবাজদের হাতে নিয়েই নেপথ্যে এমন কাজ চালিয়ে যাওয়ার তথ্য মিলেছে। পাচারকারীচক্রটি এখনো সক্রিয় রয়েছে বান্দরাবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায়। ওই এলাকা দিয়ে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় হাতি শিকার করে থাকে চক্রটি। নাইক্ষ্যংছড়ির আলীক্ষ্যং মৌজা ও ফুলতলি এলাকায় গেল বছর উপর্যুপরি দুটি হাতি হত্যার শিকার হয়েছিল। এমনকি সেই হাতি দুটির দাঁত এবং হাড়ও চক্রটি রাতের আঁধারে তুলে নিয়েছিল।
প্রতিনিয়ত খুব ঠান্ডা মাথায় খুনীরা একের পর এক গুলি করে ও বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে এবং বিষ দিয়ে হত্যা করে চলেছে হাতিগুলো। সরকার বা বন বিভাগ এখানে অসহায় হয়ে বা অদৃশ্য শক্তির ইশারায় হয়ত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিক মৃত্যু বা দুর্ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করছে। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে হাতি হত্যার সাজা হিসেবে ১০ লক্ষ টাকার জরিমানা ও ৭ বছরের সাজা দেবার কথা থাকলেও এই আইনে কারো সাজা হয়েছে বলে জানা নেই।
সম্প্রতি হাতি রক্ষায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আজ শনিবার (২৬ ডিসেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব চত্বরে ‘বিপন্ন এশিয়ান হাতি রক্ষায়’ এক মানববন্ধনের আয়োজন করে ‘প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় সম্মিলিত আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন। বক্তারা বন্যহাতি হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও হাতির পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দাবি করেছেন। এছাড়া হাতির প্রাকৃতিক চলাচলের পথ, খাবার ও পানির উৎস রক্ষায় গহীন বনে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ, অভয়ারণ্যসহ বনে পর্যাপ্ত খাদ্য শৃঙ্খল গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন। এতে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে গণসচেতনতা তৈরিতে জড়িত আরও কয়েকটি সংগঠন সংহতি প্রকাশ করে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আমাদের দেশে বাঘ নিয়ে প্রকল্প গ্রহণের আগে অব্যাহত বাঘ হত্যা, ডলফিন নিয়ে প্রকল্প গ্রহণের আগে অব্যাহত ডলফিন হত্যা দেখে সহজে অনুমেয়-সামনে হয়ত হাতি নিয়ে সরকার বড় কোন প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে! তবে এখানে হাতিদের নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের চেয়ে, অপরিকল্পিতভাবে তাদের বাসস্থান ও জলাধার এবং চলাচলের পথ বন্ধ করে যে আয়োজন-তা থেকে সরে আসলেই হাতিগুলো বেঁচে যাবে বলে তারা মনে করেন।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ