বিশ শতক থেকে যেভাবে সারা বিশ্বে অরণ্যভূমি বিনষ্ট করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, অতীতে সেভাবে কোনো দিনও হয়নি। বরং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে হাজার হাজার বছর ধরে অরণ্যবাসী মানুষ ও বন্য প্রাণী বসবাস করে এসেছে অরণ্যের অভ্যন্তরে। এরপর জনসংখ্যা যত বেড়েছে, জড়বিজ্ঞানের প্রবল প্রতাপ যত বেশি আকাশচুম্বী হয়েছে, ততই অরণ্য সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।
বিশ্বে বন উজাড়ের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কারণগুলোর একটি গরুর মাংস খাওয়ার অভ্যাস। কারণ ব্রাজিলসহ কিছু দেশে প্রতিবছর গরুর খামার গড়ে তোলার জন্য বন উজাড় করে জমি পরিস্কার করা হয়। আমাজনে প্রায়ই আগুন দিয়ে বন উজাড় করা হয়। পাশাপাশি গরু থেকে নিঃসৃত বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাসও উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ।
বিশ্বব্যাপী গরুর মাংস খাওয়া মাত্র ২০ শতাংশ কমালে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বন উজাড় ও গরুপালনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কার্বন নিঃসরণ অর্ধেক কমবে। বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচার-এ প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রসঙ্গত, মাসখানেক আগেই জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল সতর্ক করে যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্পযুগের চেয়ে সর্বোচ্চ দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে বিশ্বের কোথাও লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ চলছে না।
জার্মানির পটসড্যাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের বিজ্ঞানী ও গবেষণার প্রধান লেখক ফ্লোরিয়ান হাম্পেনোডর বলেন, গরুর মাংসের বিকল্প তৈরি করা গেলে তা পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে।
এর আগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্রোটিন নামের মাংসের একটি বিকল্প খাদ্য গ্রহণ করা হলে তা পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ইস্পাতের ট্যাংকে গ্লুকোজ ও অন্য উপাদানের সঙ্গে মাটিতে জন্মানো একটি ছত্রাক গাজন করা হলে এক ধরনের খাবার উৎপাদিত হয়, যা মাংসের বিকল্প হতে পারে। ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাজ্যে এটির প্রচলন হয়। এখন এটা অনেক দেশেই পাওয়া যায়।
পটসড্যামে খাদ্যব্যবস্থা নিয়ে অধ্যয়ন করা ফ্রানজিসকা গাউপ বলেন, গরুর মাংসের বিকল্প হিসেবে মাইক্রোপ্রোটিন ব্যবহার করা যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্যকর হতে পারে হামপেনোডর ও তার সহকর্মীরা সে বিষয়ে প্রথম ধারণা দিলেন।
গবেষণায় বলা হয়, গরুর মাংস খাওয়ার অভ্যাস ২০ শতাংশ কমিয়ে বিকল্প হিসেবে মাইক্রোপ্রোটিন গ্রহণ করা হলে ২০৫০ সাল নাগাদ মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ ১১ শতাংশ কমতে পারে। এ ছাড়া বন ধ্বংস এবং এর সঙ্গে সংশি্লষ্ট অন্য দূষণ অর্ধেক কমতে পারে।
বিশ্বব্যাপী গরুর মাংস খাওয়া মাত্র ২০ শতাংশ কমালে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে বন উজাড় ও গরুপালনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কার্বন নিঃসরণ অর্ধেক কমবে।
গবেষণায় আরো বলা হয়, গরুর মাংস খাওয়া ৫০ শতাংশ কমিয়ে মাইক্রোপ্রোটিন খাওয়া হলে বন উজাড় ও কার্বন নিঃসরণ ৮০ শতাংশ কমবে। আর ৮০ শতাংশ কমিয়ে মাইক্রোপ্রোটিন খেলে বন উজাড় ও দূষণ ৯০ শতাংশ কমবে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য পুরুষরাই বেশি দায়ি। নারীর তুলনায় পুরুষ মাংসজাতীয় আমিষ খাবার ৪০ শতাংশ বেশি গ্রহণ করে। গবেষণা অনুসারে, নারীর চেয়ে পুরুষের এই বেশি আমিষযুক্ত খাবার জলবায়ু সংক্রান্ত উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বেশি দায়ি।
এদিকে আমাজন বন উজাড়ে পরোক্ষভাবে বড় বড় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর দায় রয়েছে। কারণ, আমাজন বন উজাড়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ও অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে ব্র্যান্ডগুলোর ব্যবসায়িক সংযোগ আছে। সাপ্লাই চেইন রিসার্চ ফার্ম স্ট্যান্ড ডট আর্থের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সাপ্লাই চেইন গবেষণা ফার্ম স্ট্যান্ড.আর্থ(stand.earth) পরিচালিত এই গবেষণায় বলা হয়, ভিএইচএম, প্রাডা, জারা, কোচ, এইচ অ্যান্ড এম, নাইকি, অ্যাডিডাস, নিউ ব্যালেন্স, টেভা, ইজিসি ও ফেন্ডির মত ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্যের জন্য যেসব জায়গা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে, সেসব চামড়া কারিগরদের কাজের সঙ্গে আমাজন বন নিধনের যোগসূত্র রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যত বেশি বনাঞ্চল ধ্বংস হবে, তত বেশি মারণ ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, বনভূমি হল মানুষ ও ভাইরাসের মাঝে ঢাল। এমনটা আগেই জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। বন্য প্রাণীর শরীরে থাকা অজানা ভাইরাস ছড়ানো রোধ করতে হলে বনাঞ্চল ধ্বংস আটকাতে হবে সবার আগে।
তারা বলছেন, করোনার পরবর্তী ভাইরাস ছড়াতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্য আমাজন থেকে। কারণ সেখানে নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। আর সেটা সব থেকে চিন্তার বিষয় এখন।
সারা বিশ্বের ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগান দেয় আমাজন বনভূমি। তার থেকেও বড় কথা, এই বনভূমিতে বহু নাম না জানা প্রাণীও রয়েছে। তাদের শরীরে রয়েছে অজানা প্রাণঘাতী ভাইরাস। সেই ভাইরাস একবার মানুষের মধ্যে ছড়াতে শুরু করলে বিপদ।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সমাধানযোগ্য। আমাদের কাছে প্রযুক্তি আছে। বিজ্ঞান আছে। প্রয়োজন নেতৃত্ব এবং পথ পরিবর্তন করার সাহস। দূষণ রোধ করার জন্য শক্তির সুব্যবহার জরুরি। আমাদের ২০৫০ সালের মধ্যে বা শিগগিরই ‘নিট জিরো’ কার্বন নির্গমকে নিশ্চিত করতে হবে। নিট জিরো মানে— ক্রমান্বয়ে কার্বনের ভারসাম্যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা। নিট শূন্য নির্গমন অর্জনের জন্য, আমরা যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি এবং ব্যবহার করি তার ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার।
আমাদের একটি নতুন, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা দরকার। বনভূমি উজাড় বন্ধ করা আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। উডল্যান্ড ট্রাস্ট আগামী ১০ বছরে ৬৪ মিলিয়ন গাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাকে অনুসরণ করাই হতে পারে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার একটি বিকল্প পথ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৩
আপনার মতামত জানানঃ