অপরিকল্পিত শিল্পায়নের কারণে বিপাকে পড়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমআরএইউ)। একাধিক পোশাক কারখানার তরল রাসায়নিক বর্জ্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য গবেষণার কাজে ব্যবহৃত জমি ও পুকুরে গিয়ে পড়ছে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই গবেষক–শিক্ষকদের এখন বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের কৃষিজমি ও পুকুর ব্যবহার বন্ধ রেখে ঘরে বসেই গবেষণা করতে হচ্ছে।
জানা গেছে, পরিবেশদূষণকারী কারখানাগুলোর বর্জ্য বন্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারের সব দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করলেও কোনো লাভ হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন না করার নির্দেশ আছে পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নির্দেশ অমান্য করে অপরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে গড়ে উঠেছে শিল্পকারখানা।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুর জেলায় এখন ছোট–বড় মিলে মোট পাঁচ হাজার কারখানা রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ কারখানা স্থাপন করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এ ছাড়া ভাওয়াল বন দখল করে গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক রিসোর্ট।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সম্প্রতি গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শুধু বিএসএমআরএইউতেই নয়, গাজীপুরে যত্রতত্র যে যার মতো করে শিল্প স্থাপনা গড়ে তুলছে। এ ধরনের অপরিকল্পিত শিল্পায়নের কারণে নদী-খাল সবই দখল হচ্ছে, দূষিতও হচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলতে কিছুই নেই। ড্রেনেজ বা পানি নিষ্কাশনব্যবস্থাও দুর্বল। এখানে যেন কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন হলেও এখনো কার্যকর হয়নি।
আলাপকালে কয়েকজন পুরোনো এলাকাবাসী জানান, গাজীপুরের মানুষের কাছে একসময় মাছের বড় উৎস ছিল চিলাই নদ ও বেলাই বিল। কিন্তু চিলাই নদ দখল হতে হতে এখন খালে পরিণত হয়েছে। শিল্পবর্জ্যের কারণে এই নদ আর বেলাই বিলে আগের মতো মাছ মিলছে না।
পরিবেশদূষণকারী কারখানাগুলোর বর্জ্য বন্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারের সব দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করলেও কোনো লাভ হয়নি।
একসময় পোলট্রি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ হতো গাজীপুর থেকে। গাজীপুরে উৎপাদিত ডিম দিয়ে ঢাকার চাহিদা মেটানো হতো। কিন্তু অপরিকল্পিত শিল্পায়নের কারণে গাজীপুরে পোলট্রি ব্যবসাও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। পোলট্রি দোকানের জায়গায় গড়ে উঠেছে শিল্পকারখানা। যেমন গাজীপুর সদরের মেম্বার বাড়ি এলাকার রবিন পোলট্রি কমপ্লেক্সের জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে পোশাক কারখানা। একইভাবে বন্ধ হয়েছে বাঘের বাজার এলাকার এপিসি পোলট্রি।
স্থানীয় পোলট্রি ব্যবসায়ী তোফাজ্জল হোসেন বলেন, এই ব্যবসায়ে এখন মন্দা চলছে।
গাজীপুরের বোর্ডবাজার, আমবাগসহ কয়েকটি আবাসিক এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, যেখানে–সেখানে অপরিকল্পিতভাবে ঝুটের গোডাউন গড়ে উঠেছে।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় স্থায়ী বাসিন্দা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। শিল্পকারখানা স্থাপন বৃদ্ধি পাওয়ায় আবাসনের চাহিদা ও বাড়ি ভাড়া কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ফলে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত স্থাপনা। সড়কের জন্য তেমন জায়গা না রেখেই ইচ্ছেমতো এখানে–ওখানে তৈরি করা হচ্ছে ঘরবাড়ি। ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে খাল-বিলে।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গিয়াসউদ্দীন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধভাবে ভাওয়াল বন কেটে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে গাজীপুর। এই জেলায় পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠানও আছে। এ ধরনের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যেখানে–সেখানে শিল্পায়ন যায় না।
গাজীপুর শিল্প পুলিশ সুপার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘গাজীপুরের জন্য কোনো মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা নেই। দুটি কারখানার মাঝখান দিয়ে যাতায়াতে কোনো রাস্তা রাখা হচ্ছে না। ফলে অগ্নিকাণ্ডের সময় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দুর্ঘটনাস্থলে যেতে পারে না। যে কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়। গাজীপুরের জন্য জরুরি ভিত্তিতে মাস্টারপ্ল্যান করা জরুরি।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাজীপুরে নির্বিচার বন উজাড় করে গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্পকারখানা। বন বিভাগের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে গাজীপুরে মোট ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ বন কমেছে। পরের চার বছরে বন কমে যাওয়ার হার অন্তত ৫-৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে বলে বন বিভাগের ধারণা।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করেন, বনভূমি বেদখল হয়ে যাওয়ার অর্থ শুধু এই নয় যে এভাবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে চলে যাচ্ছে। এর অর্থ এটাও যে এইভাবে দেশের বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে এবং তার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্রে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বনভূমি উজাড় হতে হতে এখন ১৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে; অবশ্য এই হিসাব সরকারের বন অধিদপ্তরের। বেসরকারিভাবে ধারণা করা হয়, আমাদের দেশে এখন প্রকৃত বনভূমির পরিমাণ এর চেয়ে কম।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, অবৈধ দখলদারেরা সাধারণত স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাবান হয়ে থাকে, বিশেষত রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিরা এসব তৎপরতায় লিপ্ত হয় এবং তাদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ করে না। তাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অবৈধ দখলদারদের দমন করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বন বিভাগের অসাধু অংশের সঙ্গে অবৈধ দখলদারদের যোগসাজশও ছিন্ন করতে হবে। আর অবিলম্বে বেদখলে থাকা বনভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর ও ব্যাপক অভিযান চালানো প্রয়োজন বলে জানান তারা।
বন ধ্বংস হওয়ার ফলে বিপন্ন হচ্ছে পশু-পাখির আশ্রয়স্থল। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। দেশে এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় বনাঞ্চল অনেক কম। এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশ অথবা পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ এখনো যুগোপযোগী ও কল্যাণকর বন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।
শিল্পোন্নত দেশ জাপানের ভূখণ্ডের শতকরা ৭০ ভাগ এবং জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ার ৫০ ভাগ ভূখণ্ড বনে আচ্ছাদিত। সঠিক, বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের দেশেও বন সংরক্ষণ করা সম্ভব।
তারা বলেন, এজন্য নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। দেশে যে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা করা হয়েছিল, সেটির ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। গত শতকের আশির দশকে সামাজিক বনায়নের ভুল ও অপরিকল্পিত বাস্তবায়নের কারণে দেশের ‘শালবন’ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কাজেই দেশের বনাঞ্চল রক্ষায় একটি যথোপযোগী বন আইন প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৩
আপনার মতামত জানানঃ