পুরো বিশ্বে গত বছর আড়াই লাখ বর্গকিলোমিটারের বেশি বন উজাড় হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে ধ্বংস হয়েছে এসব বনভূমি। বৈশ্বিক বনভূমি পর্যবেক্ষক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে ২ লাখ ৫৩ হাজার বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। রাশিয়ার দাবানল ও ব্রাজিলের আমাজন বনভূমি ধ্বংসের কারণে বিশ্বে বন উজাড়ের হার রেকর্ড পরিমাণ বাড়তে দেখা যায়। মানবসৃষ্ট কারণে বা বনভূমি উজাড় করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ব্রাজিল। দেশটিতে ৪০ শতাংশ বনভূমি ধ্বংস ইচ্ছাকৃত।
ডব্লিউআরআইয়ের বিশ্লেষকেরা এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণের কারণে বন জলবায়ু পরিবর্তনের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দ্রুত বনভূমি ধ্বংসের কারণে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এর আগে গত বছর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের ১০০ নেতা জলবায়ু সুরক্ষায় যে পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির কোনো মিল নেই।
পরিবেশ বিশ্লেষকেরা বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমি উজাড় বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিশ্বনেতারা। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি পালন করা হচ্ছে না।
ডব্লিউআরআইয়ের বৈশ্বিক বনভূমি কর্মসূচির পরিচালক রড টেলর ২০৩০ সালে বনভূমি–সম্পর্কিত বিশ্বনেতাদের প্রতিশ্রুতি প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা বনভূমি ধ্বংস কমতে দেখছি না। বস্তুত আমরা তেমনটাই দেখার প্রত্যাশী ছিলাম।’
ডব্লিউআরআইয়ের বিশ্লেষকেরা বলেন, গ্রীষ্মাঞ্চলের ৩৭ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার পুরোনো চিরহরিৎ বনভূমি যে পরিমাণ কার্বন ধরে রাখে, তা উজাড় হওয়ার নানা দিক থেকে উদ্বেগের বিষয়। তবে আগের বছরের চেয়ে বনভূমি ধ্বংসের হার এ বছর প্রায় সমান হলেও কার্বন নির্গমনের বিষয়টি উদ্বেগের। বন ধ্বংসের ফলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণ হয়, তা ভারত এক বছরে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ালে সেই পরিমাণ কার্বন ডাই–অক্সাইড তৈরি করে।
মানবসৃষ্ট কারণে বা বনভূমি উজাড় করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ব্রাজিল। সেখানকার ৪০ শতাংশ বনভূমি ধ্বংস ইচ্ছাকৃত। কানাডা, রাশিয়া ও আলাস্কার মতো অঞ্চলেও গত বছর ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। এর কারণ, রাশিয়ায় সৃষ্ট দাবানল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট শুষ্ক ও গরম আবহাওয়া কারণে এ দাবানল সৃষ্টি হয়। টেলর বলেন, ‘এটা চরম দুশ্চিন্তার বিষয়। আমরা দেখছি বারবার আগুন ধরছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যা হতো, তার চেয়েও আরও তীব্র ও বিস্তৃত দাবানল তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে।’
মানবসৃষ্ট কারণে বা বনভূমি উজাড় করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ব্রাজিল। সেখানকার ৪০ শতাংশ বনভূমি ধ্বংস ইচ্ছাকৃত।
দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন, ভারত ও জার্মানিতে চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রেকর্ড বৃষ্টিপাত দেখেছে। ব্রাজিল, মাদাগাস্কারসহ গোটা আফ্রিকা খরায় বিপর্যস্ত। জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব।
বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে প্রতি বছর ত্বরিত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে গড় তাপমাত্রার পরিমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে অতিমাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন বিশ্বকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাবের কবলে পড়েছে গোটা বিশ্ব।
আশঙ্কার বিষয় হলো, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে ঘন ঘন এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, আগামী দিনগুলোয় এ ধরনের দুর্যোগ আরও বাড়তে পারে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি দশক অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে এমন দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টিতে; যা দৈনিক গড়ে দুটির কাছাকাছি।
জড়বিজ্ঞান সভ্যতায় বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন নগরায়ণের কারণে, শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে, আসবাবপত্র কিংবা জ্বালানির ব্যবহারে, কৃষিজমির অনুসন্ধানে এবং আরও হাজার রকমের নিষ্ঠুর অভিপ্রায় নিয়ে বিশাল বিস্তীর্ণ বনভূমিকে মানুষ নিঃশেষিত করেছে অপূরণীয় ক্ষতিতে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যত বেশি বনাঞ্চল ধ্বংস হবে, তত বেশি মারণ ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, বনভূমি হল মানুষ ও ভাইরাসের মাঝে ঢাল। এমনটা আগেই জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। বন্য প্রাণীর শরীরে থাকা অজানা ভাইরাস ছড়ানো রোধ করতে হলে বনাঞ্চল ধ্বংস আটকাতে হবে সবার আগে।
তারা বলছেন, করোনার পরবর্তী ভাইরাস ছড়াতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্য আমাজন থেকে। কারণ সেখানে নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। আর সেটা সব থেকে চিন্তার বিষয় এখন।
সারা বিশ্বের ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগান দেয় আমাজন বনভূমি। তার থেকেও বড় কথা, এই বনভূমিতে বহু নাম না জানা প্রাণীও রয়েছে। তাদের শরীরে রয়েছে অজানা প্রাণঘাতী ভাইরাস। সেই ভাইরাস একবার মানুষের মধ্যে ছড়াতে শুরু করলে বিপদ।
ব্রাজিলের পরিবেশ বিজ্ঞানী ডেভিড লাপোলা জানিয়েছেন, বনাঞ্চলে নগরায়ন করলে বিভিন্ন প্রাণী থেকে ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়ানো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমাজনের গভীর অরণ্যে বহু চেনা-অচেনা ভাইরাস রয়েছে। মানুষ বনাঞ্চল ধ্বংস করে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলে সেই ভাইরাসে সংক্রমিত হবে। আর আমাজন যেভাবে ধংস করা হচ্ছে তাতে এর পর সেখান থেকেই নতুন কোনও ভাইরাস ছড়াতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা বেশির ভাগ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়কে নিতান্তই পরিবেশের বিষয় বলে মনে করে এসেছি। বারবার নিজেদের বুঝিয়েছি বিজ্ঞানের বিষয়। এখন আর সেই অস্পষ্টতা নেই মানুষের মধ্যে। এখন বিষয়টিকে অবধারিত এক বৈশ্বিক ঘটনা হিসেবে দেখা হয়, যা অর্থনীতি, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, জীবনযাপন, খাবারের জোগান, এমনকি রাজনীতি পর্যন্ত— আমাদের জীবনের প্রতিটি দিককে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে আমাজন। প্রায় ৩০ লাখ স্বতন্ত্র প্রজাতির গাছপালা ও প্রাণীর আবাসস্থল এই আমাজন। প্রতিবছর মিলিয়ন মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নেয় আমাজনের বিস্তৃত বনাঞ্চল। এই গাছগুলো যখন কাটা হয় বা আগুনে পুড়ে যায়, তখন শোষণ করে রাখা কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫২
আপনার মতামত জানানঃ