বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক তিনজনের মৃত্যু হলেও চার শিশু বেঁচে যায়। নিখোঁজ বিমানে কেউ বেঁচে নেই বলেই ধরে নেয় কর্তৃপক্ষ। ১৬ দিন পর একদল আদিবাসী বিমানটির সন্ধান পায়। সেখানে তারা তিনটি মরদেহ খুঁজে পায়। তখন প্রশ্ন ওঠে শিশুরা কোথায়? একটি বোতল, একটি আধখাওয়া আপেল, চুলের বাঁধন ও কয়েকটি ডায়াপার পাওয়া যায়। এসব কিছু ইঙ্গিত করে যে শিশুরা বেঁচে আছে।
ইঞ্জিন বিকল হয়ে আমাজন বনে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। পাইলট ও এক নিকট আত্মীয়সহ শিশুদের মায়ের মরদেহ বিমানের ভেতরেই পড়ে ছিল। তবে বেঁচে যায় ১৩ বছর বয়সী মেয়ে লেসলি ও তার ছোট তিন ভাইবোন। সাহায্য করার মতো তখন কেউ নেই তাদের পাশে। লেসলি একাই এই বিপজ্জনক বনে ভাইবোনদের বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা শুরু করে। ৪০ দিন পর রুগ্ন ও ভীত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করা হয়।
চার শিশু তাদের পরিবারের সাথে আমাজন জঙ্গলের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শহর আরারাকুয়ারাতে বাস করত। ১৯৩০-এর দশকে এক কলম্বিয়ান প্রেসিডেন্ট এই স্থানেই সবচেয়ে বিপজ্জনক অপরাধীদের আটকে রাখার জন্য একটি কারাগার নির্মাণের নির্দেশ দেন। তবে সেখানে আসলে কোনো কারাগার ছিল না। অপরাধীরা বাইরেই জলাভূমির মাঝখানে বসবাস করত। যারা সেখান থেকে পালানোর চেষ্টায় জঙ্গলে ঢুকত, তারা মূলত নিজের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করত। এখানে বাস করাই ছিল তাদের শাস্তি। সেই অপরাধীদের পরবর্তী প্রজন্ম, যারা সেখানে জন্মগ্রহণ করেছিল, তারা সাপ, জাগুয়ার ও বিষাক্ত উদ্ভিদের মধ্যেই বেঁচে থাকা শিখে যায়।
সে জলাভূমি একসময় হয়ে ওঠে ছোট শহর। এখানে বসবাস করা মেয়ে লেসলিও আমাজনের রহস্য সম্পর্কে অবগত। শিশুদের চাচা জানান, লেসলি জানে কীভাবে বনের গাছের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলো দেখে পথ খুঁজে নিতে হয়। সে নিরাপদ পথ চিনতে পারে এবং কোন মাশরুম খাওয়া যাবে তাও বোঝে। একজন শহরবাসীকে বনে টিকে থাকতে সংগ্রাম করতে হবে, তবে আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন সহজেই বনে চলাচল করে। জুতা ছাড়াই তারা বনে প্রতিদিন ১৯ মাইল পর্যন্ত হাঁটতে পারে। লেসলি সে শিক্ষা নিয়ে বড় হয়েছে আর সেটিই লেসলি এবং তার ভাইবোনের জীবন বাঁচিয়েছে।
গত ১ মে ছোট বিমান সেসনা ২০৬-এ চড়ে মা ম্যাগদেলেনা মুকুতয়ের সঙ্গে চার শিশু তাদের বাবা ম্যানুয়েল রানোকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল। রানোক আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত পার্শ্ববর্তী একটি জায়গার গভর্নর হিসেবে কাজ করতেন। গেরিলাদের হুমকির মুখে তিনি আরারাকুয়ারা ছেড়ে পালিয়ে যান। রাজধানী বোগোতায় তিনি নিজের পরিবার নিয়ে নতুন জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখছিলেন।
বিমানটি আরারাকুয়ারা থেকে নিকটতম বিভাগীয় রাজধানী সান হোসে ডেল গুয়াভিয়েরে গিয়ে অবতরণ করার কথা ছিল। এ পথের ফ্লাইটগুলো দীর্ঘ সময় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যায়। আপাপোরিস নদীর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় পাইলট কন্ট্রোল টাওয়ারে ইঞ্জিন বিকল হওয়ার খবর জানান। আর টাওয়ারের সঙ্গে এটাই ছিল তার শেষ যোগাযোগ। এরপর বিমানটি ধীরে ধীরে নিচে পড়তে থাকে। বিমানের পথ বিবেচনা করে ধারণা করা হচ্ছে, পাইলট বিমানটি নদীতে নামাতে চেয়েছিলেন। তবে ব্যর্থ হয়ে গাছের ওপর অবতরণের চেষ্টা চালান। এ প্রচেষ্টায় বিধ্বস্তের মাত্রা কমা ছাড়া আর কিছুই হয়নি।
বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক তিনজনের মৃত্যু হলেও চার শিশু বেঁচে যায়। নিখোঁজ বিমানে কেউ বেঁচে নেই বলেই ধরে নেয় কর্তৃপক্ষ। ১৬ দিন পর একদল আদিবাসী বিমানটির সন্ধান পায়। সেখানে তারা তিনটি মরদেহ খুঁজে পায়। তখন প্রশ্ন ওঠে শিশুরা কোথায়? একটি বোতল, একটি আধখাওয়া আপেল, চুলের বাঁধন ও কয়েকটি ডায়াপার পাওয়া যায়। এসব কিছু ইঙ্গিত করে যে শিশুরা বেঁচে আছে।
লেসলি, সোলেইনি (৯), তিয়েন নোরিয়েল (৪) ও ক্রিস্টিন নেরিম্যান (১) জঙ্গলের ভেতর যাত্রা শুরু করে। এ যাত্রায় নেতৃত্ব দেয় লেসলি। তাদেরকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে সে। যা পেয়েছে তাই খেয়ে বেঁচে ছিল তারা। পরে উদ্ধারকারীরা আকাশ থেকে খাবার ফেলেন তাদের জন্য। কলম্বিয়ার বিশেষ বাহিনীর ১০০ সদস্য ও ৭০ জন আদিবাসী শিশুদের উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন।
জঙ্গলের ভেতরে শিশুরা একটা কুকুরের দেখা পায়। প্রাণীটি দীর্ঘ সময় তাদের সঙ্গে ছিল। একসময় কুকুরটিকে আর পাওয়া যায়নি। জঙ্গলের ভেতরে সবসময় রাতের মতো অবস্থা থাকে, কারণ উঁচু উঁচু গাছের ফাঁক গলে খুব কমই আলো ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। জঙ্গলে এতটাই অন্ধকার যে, ২০ মিটার দূরের কিছুও দেখতে পাওয়া যায় না। এ দূরত্বের বাইরে গিয়ে কেউ পথভ্রষ্ট হলে সে ব্যক্তি চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশুরা সেখানে নিশ্চয়ই কাছাকাছি থেকেছে। লেসলিই বেশিরভাগ সময় এক বছর বয়সী ছোট ভাইকে বহন করেছে বলে জানা গেছে।
শিশুরা বুঝতে না পারলেও তাদের খুঁজে পাওয়া কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টের জন্য অনেক গর্বের এক বিষয়। বিমান খুঁজে পাওয়ার কয়েকদিন পর প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো টুইট করে শিশুদের জীবিত উদ্ধারের খবর জানান। যা রীতিমত ভাইরাল হয়ে যায়। তবে সামরিক বাহিনী সে তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি। পরে জানা যায়, শিশুরা বেঁচে আছে এমন সম্ভাবনা থেকেই ভুলবশত টুইট করে প্রেসিডেন্ট কার্যালয়। এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে আরও সতর্ক না হওয়ায় সমালোচিত হন প্রেসিডেন্ট। এরপর শিশুদের খুঁজে পেতে সর্বাত্মক চেষ্টার নির্দেশ দেন তিনি। এটাকে জাতীয় অগ্রাধিকার বলেও আদেশ দেন তিনি।
ইতোমধ্যে দুর্ঘটনার ২০ দিন পেরিয়ে যায়। উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া পেদ্রো সানচেজ বলেন, ‘শিশুরা যদি আদিবাসী সম্প্রদায়ের না হতো তাহলে তাদের জীবিত উদ্ধানের সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ হতো।’ লেসলির প্রতি তার আস্থা ছিল।
উদ্ধারকারীরা শত শত মাইল হেঁটেও শিশুদের খুঁজে পায়নি। অনুসন্ধানে এত দীর্ঘ সময় লাগছিল যে দেশের মানুষজন এক সময় চার শিশুর কথা প্রায় ভুলেই যায়। মানুষজন আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তবে কমান্ডার সানচেজ এসব পাত্তা না দিয়ে উদ্ধার অভিযানে অনড় থাকেন। শিশুরা মারা গেলে লাশ খুঁজে পাওয়া যেত বলে বিশ্বাস ছিল তার।
উদ্ধার অভিযানে যুক্ত আদিবাসীরা জঙ্গলে ঢোকার আগে প্রবেশের অনুমতি চেয়ে প্রার্থনা করে। তাদের এমন অনেক বিশ্বাস আছে যা অন্যদের বোঝা কঠিন। তাদের কাছে জঙ্গল হলো একটি জীবিত সত্তা যার বিচারবুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তি আছে। শিশুদের দাদী মনে করেন, শিশুদের যাতে খুঁজে পাওয়া না যায়, সে কারণে এলাকার যাযাবর উপজাতিরা তাদের আদিশক্তি প্রয়োগ করেছে। চার ভাইবোন তাদের সঙ্গে থাকুক তা চেয়েছে উপজাতিরা।
সানচেজ আশঙ্কা করেছিলেন, কোনো বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায় শিশুদের পেয়ে নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছে।
অবশেষে দুর্ঘটনার ৪০ দিন পর অনুসন্ধান দল চারজনকে খুঁজে পায়। সেনারা হেলিকপ্টারে করে অপুষ্টিতে ভোগা ও ক্লান্ত চার শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। লেসলি আজ কলম্বিয়ায় কিংবদন্তী হয়ে উঠেছে।
এসডব্লিউএসএস/০৮১০
আপনার মতামত জানানঃ