১২ জুন ২০২৫, ভারতীয় স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৩৮ মিনিটে আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট AI-171 ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার মডেলের এই যাত্রীবাহী বিমানটিতে ২২৯ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রুসহ মোট ২৪১ জন আরোহী ছিলেন। টেকঅফের পর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিমানটি প্রায় ৬২৫ ফুট উচ্চতায় পৌঁছেই অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে এবং কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে পাইলটের সংক্ষিপ্ত ‘মায়ডে’ সংকেতের পর হঠাৎই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপরই বিমানটি আহমেদাবাদের একটি আবাসিক এলাকার কাছাকাছি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের পাশ দিয়ে আছড়ে পড়ে, ফলে নিচের ভবনগুলিতেও ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিস্ফোরণ, আগুন এবং ধোঁয়ার কারণে পুরো এলাকা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
দুর্ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় ফায়ার সার্ভিস, এনডিআরএফ, অ্যাম্বুলেন্স এবং পুলিশ বাহিনী। স্থানীয় হাসপাতালগুলিকে সতর্ক করে দেয়া হয় এবং আহতদের জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয়। এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হয়নি কতজন আরোহী প্রাণ হারিয়েছেন, তবে কিছু রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গুরুতর আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ দ্রুত একটি হেল্পলাইন চালু করে যাত্রীদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার উদ্যোগ নেয়। পাশাপাশি বোয়িং কোম্পানিও তাদের টেকনিক্যাল টিমকে তদন্তে পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
দুর্ঘটনার খবর প্রকাশের পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে কথা বলেন এবং দ্রুত উদ্ধার কাজ ও তদন্তের নির্দেশ দেন। কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ব্রিটেন ও কানাডার দূতাবাস থেকেও যাত্রীদের স্বজনদের প্রতি সহানুভূতি জানানো হয়েছে এবং তারা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে সহযোগিতা দিচ্ছে। কারণ বিমানটিতে বিদেশি নাগরিকরাও ছিলেন।
এই দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। যেহেতু বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের এটি প্রথম বড় ধরনের দুর্ঘটনা, তাই প্রযুক্তিগত ত্রুটির সম্ভাবনা প্রথমেই সামনে এসেছে। পাইলটের মায়ডে কল একটি সংকেত দেয় যে হয়তো কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি বা নিয়ন্ত্রণ হারানোর মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তবে বিমানটি কেন এত দ্রুত নিচে নেমে এলো, কিংবা কেনই বা কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে পুরো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তা এখনো রহস্যই রয়ে গেছে। আবহাওয়া দুর্ঘটনার সময় স্বাভাবিক ছিল, ফলে প্রাকৃতিক কোনো কারণ তাৎক্ষণিকভাবে সামনে আসেনি।
বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে কিছু ব্যবহারকারী দুর্ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি হামলা বা পাকিস্তানি সংযোগ খুঁজতে চেষ্টা করছেন। তবে সরকারিভাবে এখনো পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি যা সন্ত্রাসবাদ বা বিদেশি ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। বাস্তবে, এই দুর্ঘটনা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোন জঙ্গিগোষ্ঠী দায় স্বীকার করেনি এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তা রেকর্ডেও কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপ পাওয়া যায়নি। অতীতে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২-এর মতো কিছু নজির থাকলেও সেগুলি ভিন্ন ভূখণ্ড ও প্রেক্ষাপটে ঘটেছিল। এই দুর্ঘটনা এখনও পর্যন্ত প্রধানত একটি প্রযুক্তিগত বা যান্ত্রিক সমস্যা বলেই ধরা হচ্ছে, যদিও চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়।
তদন্তকারীরা ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল থেকে ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করেছেন এবং বিমানের ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার ও ককপিট ভয়েস রেকর্ডার বিশ্লেষণের কাজ শুরু হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমেই বোঝা যাবে শেষ মুহূর্তে ককপিটে ঠিক কী ঘটেছিল এবং পাইলট কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। বোয়িং কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে এবং প্রয়োজনে অতিরিক্ত প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করবে।
এদিকে, দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে দেশের অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এয়ার ইন্ডিয়া, যা এখন টাটা গোষ্ঠীর অধীনে পরিচালিত হয়, তারা এরকম একটি প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার পর তাদের রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালা এবং পাইলট প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নতুন করে পর্যালোচনা করতে পারে। ভারতীয় বিমান চলাচলের ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ট্র্যাজেডি হতে চলেছে যদি আশঙ্কা অনুযায়ী বেশিরভাগ আরোহী মারা যান।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মৃত এবং আহতদের শনাক্ত করা, তাদের পরিবারকে তথ্য প্রদান করা, এবং সেইসঙ্গে সংবাদ মাধ্যমে যাচাই না করা গুজব প্রতিরোধ করা। সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে যাতে গণমাধ্যম ও জনগণ অনুমানভিত্তিক তথ্য প্রচার না করে। পুরো জাতি এখন এই মর্মান্তিক ঘটনার তদন্ত এবং সত্য উদ্ঘাটনের দিকে চেয়ে আছে, যেখানে প্রতিটি তথ্য হতে পারে বিচার ও জবাবদিহির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
দুর্ঘটনার ভয়াবহতা যেমন হৃদয়বিদারক, তেমনি তদন্তে স্বচ্ছতা ও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন আচরণ প্রত্যাশিত। কারণ এরকম দুর্ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত নয়, জাতীয় ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়। এই শোকাবহ ঘটনার মধ্যেও সকলে আশাবাদী যে সত্য উদঘাটিত হবে এবং ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার মতামত জানানঃ